ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণপরিবহনে নারীর ভোগান্তি ও প্রতিকার

মোহাম্মদ ইলিয়াছ
গণপরিবহনে নারীর ভোগান্তি ও প্রতিকার

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর আর্থসামাজিক অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। শিক্ষিত নারীর হার যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশের নারী কর্মজীবীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মজীবী নারীর পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও নারীরা এখন ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি পরিবহন সুবিধা। বাড়েনি নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যাও, একটি বাসে নারীদের সর্বোচ্চ বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা থাকে ১২টি। বাকি সব আসন থাকে পুরুষদের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আবার অনেক সময় বসার আসন না থাকলে বা রাত একটু বেশি হলে গণপরিবহনে নারীদের তোলা হয় না। আর বাসে নারীদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে কারণে বাইরে কাজ করা থেকে অনেক নারী আগ্রহ হারাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই অল্পসংখ্যক আসনও অনেকাংশে দখল করে নেন পুরুষরা। এ ছাড়া নারীদের আসনে বিভিন্ন মালামাল ও বস্তা উঠানোর ফলে সংরক্ষিত মহিলা আসনের উপযোগিতা নষ্ট হয়। এমনকি এ ঘটনা এখন প্রতিটি বাসে খুবই স্বাভাবিক যে, নারীদের সিটে পুরুষ বসে আছেন আর নারীরা সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এক্ষেত্রে বাসচালক বা হেলপারের ভূমিকা থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীবিরোধী। অনেকবার সিট ছাড়ার কথা বলা হলেও তারা ভ্রƒক্ষেপ তো করেই না, উল্টো ‘এত সমস্যা হলে রিকশাতে যান’ বলে হুমকিও শুনতে হয়। কার্যকারণস্বরূপ, অধিকাংশ নারী তাই চুপ থাকাটাকেই পছন্দ করেন। দিন দিন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাটি আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ৪১-৬০ বছর বয়সি পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী, যার হার ৬৬ শতাংশ। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি। এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারী বলেছে, তারা চুপ থাকে এবং ৭৯ শতাংশ বলেছে আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যায়। বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহনসংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী। আবার আরেক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক জরিপ বলছে, তাদের জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ৮৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা জনসমাগমস্থলে অশালীন মন্তব্য শুনেছে এবং পুরুষরা যৌন হয়রানি করার সুযোগ খুঁজেছিল। অর্ধেকের বেশি নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আবার কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সবচেয়ে বেশি, ৮৭ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোয় ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গণপরিবহন ব্যবহার করেন। ওই জরিপে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যাত্রী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক গবেষণা রিপোর্টে জানা যায়, গণপরিবহনে শতকরা ৪১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার। যৌন হয়রানি মুক্তি পেতে শতকরা ৩১ ভাগ নারী গণপরিবহনে যাতায়াত করে না, যা নারীদের কর্ম, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে নয়টি আসন সংরক্ষিত রাখার নিয়ম রয়েছে। তবে সেই আসনগুলো থাকে চালকের আসনের কাছাকাছি। অনেক বাসে ইঞ্জিনের ওপর নারীদের বসার ব্যবস্থা রাখা হয়। সেই বরাদ্দকৃত আসনগুলোও অনেক সময় পুরুষদের দখলে থাকে। তা ছাড়া ইঞ্জিনের গরমে পা রাখা বা বসে থাকা কষ্টকর ব্যাপার। নারী আসন নিশ্চিতকরণে স্টপেজগুলোয় সার্জেন্টদের তদারকির প্রয়োজন এবং নিয়ম লঙ্ঘনে জরিমানার ব্যবস্থা চালক ও ভাড়া আদায়কারীকে বাধ্য করবে মহিলা আসন সংরক্ষণ করতে। সিটিং সার্ভিস চালু করাও আবশ্যক। এতে করে ভিড়ের জন্য বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে না নারীদের। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে পুরুষদের আরো দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। নারী হয়রানির ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। প্রতিটি বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার দ্বারা অপরাধী চিহ্নিতকরণ করার পাশাপাশি অপরাধের পরিমাণ কমিয়ে আনাও সম্ভব। সর্বোপরি একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করে গড়ে তুলতে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে নারীদের যাতায়াত সমস্যা দূর করতে আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা। বাসে সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর জন্য নাগরিকদের সচেতনতা প্রয়োজন। এ ছাড়া নারীদেরও নিজের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। কর্মস্থলে ও নানা কাজের ও বিষয়ের প্রয়োজনীতায় এখন নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে অতীতের তুলনায় বেশি। পাশাপাশি সমান তালে তার নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা বা বাহন বাড়েনি। দেশ রাষ্ট্রসমাজের সবক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিরাপদ বিড়ম্বনাহীন যাতায়াত ব্যবস্থা বা বাহন নিশ্চিত না হলে নারী উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি সামর্থবানদের এগিয়ে আসতে হবে এ সমস্যা নিরসনে। আর নারীদের হতে হবে অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক।

লেখক : উপ-পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত