ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নারীর অগ্রযাত্রা

অলোক আচার্য
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নারীর অগ্রযাত্রা

উন্নয়নের অংশীদার নারী ও পুরুষ। যদি একটি অংশ দুর্বল থাকে, তাহলে সুষম উন্নয়ন অসম্ভব। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি অবদানেই এগিয়ে চলেছে। আমাদের দেশেও সেটাই হচ্ছে। একসময় যে ক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ চিন্তা করা যেত না অথবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতো, সেই ক্ষেত্রগুলো এখন মুক্ত। ফলে নারীরা স্বাধীনভাবে এসব ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

দেশ যতই এগিয়ে চলেছে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের কর্মজজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়ন কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। সেই সুযোগের শুরু হয় শিক্ষা থেকে। আজ প্রতিটি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রবাস, আইসিটি মোটকথা অর্থনীতি প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। যেখানে নারীরা ঘরের কাজ করত, এখন সেখানে চাকরি-ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেখাপড়া শেষে নারী-পুরুষ উভয়ই চাকরির জন্য প্রতিযোগিতায় বসছে। সংসার পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তারা চাকরি, ব্যবসা করছে। গ্রামে প্রায়ই ছোটোখাটো দোকান চালাতে দেখা যায় নারীদের। ঘরে বসে আজ ই-কমার্সের যুগে নারীরা ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে যেখানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ সেখানে ২০১৬-১৭ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬ লাখ। এই সময়ের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এ সবই নারী শিক্ষার অগ্রগতির ফলেই সম্ভব হয়েছে।

নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান শিক্ষা। প্রায় প্রত্যেকবারই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ফলাফলে এগিয়ে রয়েছে। পাসের হার এবং জিপিএ দুই ক্ষেত্রেই সাফল্যের দাবিদার নারীরা। শিক্ষা সব অন্ধকার দূর করতে সক্ষম এই সূত্র মেনেই নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে অন্ধকারে থাকলে নারী কোনোদিনই আজকের পর্যায়ে আসতে পারত না। কিন্তু শুরুতে এই বিষয়টা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটা সময় নারীদের স্কুল-কলেজে পড়া ছিল সামাজিকভাবেই বাধা। পরিবার থেকেই নারী শিক্ষাকে নিরুৎসাহিক করা হয়েছে বহু বছর। যেসব নারী শিক্ষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অগ্রসরমান ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, তাদের পরিবার তাদের সাহায্য করেছে। বাকিদের নিয়তি ছিল ঘর-সংসার সামলানোর কাজ করা। স্কুলে ভর্তি হওয়া, যাওয়া এবং ক্লাস করা এই সমর্থন পাওয়া পরিবার থেকে খুব দূরহ ছিল। বেগম রোকেয়ার মতো কিছু মহিয়সী নারী সমাজের এই শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছিলেন। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে প্রাণাবন্ত শ্রম দিয়েছেন। সমাজের কুসংস্কারকে উপেক্ষা করে কঠোর সংগ্রাম করেছেন।

সেখান থেকে নারী শিক্ষার এই যাত্রা শুরু হয়ে যুগের পর যুগ পার হয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা ছিল না। এই ধারণা যে আজও একেবারেই নির্মূল হয়েছে তাও বলা যাবে না। তবে শিক্ষার মতো অতি মৌলিক এই ক্ষেত্রে নারীরা এখন প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সব সরকারই নারী শিক্ষা এগিয়ে নিতে গুরুত্বারোপ করেছে। বিভিন্নভাবে নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী করার চেষ্টা করেছে। নারী শিক্ষকতাসহ কর্পোরেট চাকরির বড় অংশেই যোগ দিয়েছে নারী। প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার চিত্র অনেকটাই সাফল্যের। শিক্ষা অধিদপ্তরের অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ’১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় দেশের মোট শিক্ষার্থীও মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশের কিছু বেশি। মাধ্যমিক স্তরে ১৯৯৮ সালের পর থেকে সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে আছে নারীরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, দেশের ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ শতাংশ নারী শিক্ষক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্চুরি কমিশন। মঞ্জুরি কমিশনের ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে মতে- ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে মোট শিক্ষক ছিলেন ২ হাজার ৩১৭ জন। সে সময় নারী শিক্ষক ছিলেন ২০৩ জন অর্থাৎ ৮ শতাংশ। ৫০ বছরে এই হার বেড়েছে ২১ শতাংশ। ইউজিসি এর তথ্য মতে, বর্তমানে পুরুষ শিক্ষকদের চেয়ে ৭০ শতাংশ পিছিয়ে আছেন নারী শিক্ষকরা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও নারী শিক্ষক বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষা অর্জনে নারীর অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর নারী দিবসের আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় শতকরা ৪৯ দশমিক ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিকে এ হার ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ হলেও সবচেয়ে কম উচ্চশিক্ষায়; যা শতকরা হিসেবে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মোট ২ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৩ জন, শতকরায় যা ৫০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষায়তনে মোট নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৪ জন। বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষকতায় ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশই নারী। বিপরীতে মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকের হার ২৮ দশমিক ৮২ শতাংশ; ২০১২ সালে যে হার ছিল ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর উচ্চমাধ্যমিকে এ হার আরও কম, মাত্র ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষকের হার কিছুটা বেশি ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর সামগ্রিক চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ২৮ শতাংশের মতো। সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ৪২তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশকৃত ৪ হাজার জনের মধ্যে ২ হাজার ৩৯ জন (৫০.৯৮ শতাংশ) পুরুষ এবং নারী ১ হাজার ৯৬১ জন (৪৯.০২ শতাংশ)। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার সীমাবদ্ধ রয়েছে ২৭ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যেই। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিসিএসের মাধ্যমেও চাকরিতে নারীর হার খুব একটা বাড়ছে না এবং শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। সরকারের ৭৭ জন সচিবের মধ্যে নারী মাত্র ১০ জন। আর বর্তমানে দেশের ১৫ লাখেরও অধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নারী ৪ লাখ ১৪ হাজারের মতো। বর্তমানে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও সীমিত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশ নারী (স্নাতকে এ হার ৪৪ ও স্নাতকোত্তরে ৫৫), এবং পিএইচডি পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ। বৈশ্বিক হিসেবে উচ্চশিক্ষায় নারী পুরুষের প্রায় সমকক্ষ হয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। সম্প্রতি গবেষণা নিয়ে কাজ করা সম্মানজনক ‘নেচার সাময়িকী’র এক গবেষণায় বলছে, ৮৩ হাজার গবেষণাপত্রের মাত্র ১৭ শতাংশের প্রধান গবেষক ছিলেন নারী। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী শিক্ষার্থীর হার মাত্র ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০২১ সালে বুয়েটে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৬২২ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫৮৯ জন ছিল নারী শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার ৬২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬ হাজার ২২৩ জন ছিল নারী শিক্ষার্থী। ইউজিসির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ব্যানবেইস বলছে, দেশে ১৬০টি সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ২৯ শতাংশ ও ৩৬ শতাংশ।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকদের যেহারে এগিয়ে রয়েছে, উচ্চ শিক্ষায় সেভাবে এগিয়ে যেতে না পারলেও এই অগ্রগতিই একসময় নারীদের এগিয়ে রাখবে। নারীর কাজের ক্ষেত্র এখন সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় ক্ষেত্র পোশাক শিল্পে একটি বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করছে। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে নারীর উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে নারী শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করার বিকল্প নেই। যে প্রতিবন্ধকগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। বিশেষ করে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপ আজও বহু মেধাবী নারীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। তারা পূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই ধ্বংস হচ্ছে। প্রতি বছর স্কুল-কলেজে পড়া বহু মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হয়। একটি সভ্য জাতির কাছে যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা; কিন্তু অতীতকাল থেকেই নারীরা অবহেলিত। নারীরা যেভাবে শিক্ষায় এগিয়ে চলেছে, তাদের সে ধারা অব্যাহত থাক। সমাজে শিক্ষা আলো হয়ে নারী-পুরুষ উভয়কে সঠিক পথে পরিচালিত করুক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত