ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই কেন যেন চ্যালেঞ্জ

অতি মুনাফাখোররা কি আসলেই বেশি শক্তিশালী!
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই কেন যেন চ্যালেঞ্জ

নিত্যপণ্যের অতিমূল্য নিয়ে পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকারকে সতর্ক করে আসছিল। তবে সরকার তাতে কর্ণপাত করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা বোধহয় সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনগুলো প্রতিদিনই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিদিনের টক-শো অনুষ্ঠানে আলোচকরা পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণের দাম নিয়ে কথা বলছেন। আলোচকদের মধ্যে যারা আওয়ামী মনোভাবাপন্ন তারাও প্রশাসনের সমালোচনা করছেন। সরকার কোনো কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে ওই পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। সরকারের সকল স্তরের সংস্থা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানাও করছে। তবে কাজের কাজ কোনো কিছুই হচ্ছে না। কেন কাজ হচ্ছে না, সেই বিশ্লেষণ সরকার করছে না কেন? আওয়ামী লীগের অনেক নেতা রয়েছেন, তারা প্রশাসনের সঙ্গে মিলে কেন বাজার তদারকি করছেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষ অতিষ্ঠ। মুসলিম জাহানের অন্য কোনো দেশে পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের দাম কমে। অথচ আমাদের দেশে বাড়ে। তাহলে কি সরকারকে সংকটে ফেলার জন্য আমাদের দেশের বিএনপি মনোভাবাপন্ন ব্যবসায়ীরা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদের দেশের আওয়ামী মনোভাবাপন্ন ব্যবসায়ীদের বিষয়টি উঠে আসে। বিএনপি মনোভাবাপন্ন ব্যবসায়ীরা তো আর সব পণ্যের ব্যবসা করে না। আওয়ামী মনোভাবাপন্ন ব্যবসায়ীও তো আছে। তারাও তো পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে না। তাহলে কি তাদের কাছে দলের চেয়ে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে গেল। বছরের ১১ মাস ব্যবসায়ীরা কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও রমজান মাসে তারা সারা বছরের লাভ করতে চায়। এই মনোভাব কেন হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। রমজানে কি মানুষ আসলেই অনেক বেশি খায়, যে পণ্যের সরবরাহ কমে যাবে। আর পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে দাম আপনা আপনি বেড়ে যায়। রমজানে মানুষ খুব যে একটা বেশি খায়, তা নয়। ১১ মাস যেভাবে খেয়েছে, ঠিক সে রকম না হলেও হয়তো রমজান মাসে মানুষ একটু উন্নতমানের খাবার খেতে পছন্দ করে। আর তার অর্থ এই নয় যে, পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়ে যাবে। কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে প্রতিটি স্তরে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। আর এ বাড়ার পরিমাণ এতোই বেশি যে তা কল্পনাতীত।

আমাদের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী প্রতিদিনই বাজার চষে বেড়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের মূল্য ক্রেতাদের ক্রয়সীমানার মধ্যে রাখতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে তাহলে কি বিএনপিই দায়ী। কোনো কিছু হলে তার দায় চাপানো হয়, বিএনপির ওপর। তাহলে কি বিএনপি বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই প্রশ্ন আসতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিদিন বিএনপিকে নিয়ে যত কথা বলে সময় নষ্ট করেন, সেই সময়টুকু বাজারের গিয়ে পণ্যমূল্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে জনগণের উপকার হতো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য কিংবা সহনীয় মাত্রায় আনার জন্য বাজারে তৎপরতা চালাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাজার মনিটরিং টিম। এছাড়া জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাবের সদস্যরাও সহায়তা করছেন। সরকারের যত ধরনের সংস্থা আছে, প্রায় সবাই মাঠে নেমেছে পণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলোরও সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়া বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীসহ অন্যরা প্রায় প্রতিদিনই বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবুও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন, সেই জবাব দেবে কে? তাহলে কি মানুষ মনে করবে, অতি মুনাফাখোররা অধিক বেশি শক্তিশালী। সরকার না অতি মুনাফাখোররা বেশি শক্তিশালী, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলার সংকটের দোহাই দিয়ে তো পার পাওয়া যাবে না। যে পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে ডলারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, সেসব পণ্যের দাম তিন-চারগুণ বেশি কেন। প্রশ্ন আসতে পারে একটি লেবুর দাম কেন ২০ টাকা হবে। লেবু তো আমাদের দেশের কৃষকরা ফলায়। যেসব পণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়, বাইরে আমদানিও করতে হয় না, তারও কেন আগুন দাম?

আবার সয়াবিন তেলের দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়ার এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও এখনো কেন বাজারে দাম কমলো না? দোকানদারদের অজুহাত দেন আগের দামে কেনা সয়াবিন তেল এখনো রয়ে গেছে, তাই নতুন নির্ধারিত কম দামে বিক্রি করতে পারছেন না। কিন্তু যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ঘোষণা আসে, তখন কেন দোকান থেকে আগের কম দামে কেনা তেল হাওয়া হয়ে যায়? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা একটা জটিল সমীকরণ। এ সমীকরণের হিসাব মেলানো হয়তো কারো সাধ্যের মধ্যে নেই। ইসবগুলের ভুষি কেজিতে ৮০০ টাকা দাম বেড়েছে। পৃথিবীর অন্য দেশ যেখানে বিভিন্ন উৎসব, পার্বণে বড় বড় ছাড় দেয়, সেই জায়গায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ধর্মকে পুঁজি করে কীভাবে হরিলুট করবে, সেই আশায় ব্যস্ত থাকে। একজন মন্ত্রী খেজুরের পরিবর্তে বরই খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। ভালো কথা খেজুর আর বরইয়ের স্বাদ কি এক। বিশেষ করে রমজান মাসের সঙ্গে খেজুরের একটা ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্পর্ক রয়েছে। সেই মাসে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার কথা বলে মন্ত্রী মহোদায় মানুষের সঙ্গে তামাশা করেছেন। পরে অবশ্য বলেছেন, তিনি নাকি আপেলের পরিবর্তে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে আমাদের দেশের মন্ত্রিরা মাঝেমধ্যে এমন সব কথা বলেন তা শুনলে রীতিমতো মসকরা বলেই মনে হয়। আর বেশি দামি পণ্যটি বর্জন করলেও খুব একটা লাভ হয় না। কেন না, যাদের হাতে অনেক টাকা আছে, তাদের কাছে দাম কোনো ব্যাপার নয়। বাস্তবতায় বলা যেতে পারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কেন যেন সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত