ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র দেশীয় বিনিয়োগে শিল্প বিকাশ

এস এম মুকুল
সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র দেশীয় বিনিয়োগে শিল্প বিকাশ

অর্থনৈতিভাবে উন্নত দেশগুলো প্রধানত শিল্পকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে। এরফলে দেখা গেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে ঘটেনি। আমাদের দেশে অধিকাংশ শিল্প উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তিক বা সামষ্টিক প্রয়োজন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে। এ ধরনের উদ্যোগকে আইনগত সীমাবদ্ধতার অজুহাতে আটকে দিলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন দূরূহ হবে। সরকারের কাজ আপন চেষ্টায় গড়ে ওঠা শিল্পকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া।

উন্নয়নশীল জনবহুল বাংলাদেশে গত দুই দশকে দারিদ্র্যের হার ৫৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৪০ শতাংশে। সে হিসেবেও দেশে ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে (সূত্র. বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র)। দেশে সম্পদ, দরিদ্র্যাবস্থা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান ব্যবস্থার আনুপাতিক হারের সঠিক পরিসংখ্যান যেমন নেই, তেমনি পরিকল্পনা বা সামঞ্জস্যও নেই নীতি-নির্ধারণ বা উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে। এর মধ্যদিয়েই আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিক্রম করেছি। দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা, নিজেরা না করা অন্যকেও করতে না দেয়া, এমন পরস্পরবিরোধী মানসিকতা কার্যত দেশের উন্নয়ন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। পিছিয়ে রাখছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে। অথচ এমন অসহযোগ পরিবেশের মধ্য দিয়েই দেশে বিকশিত হচ্ছে অনেক দেশীয় শিল্প উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশকিছু বাণিজ্যিক গ্রুপ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এধরনের শিল্প উদ্যোগের ভূমিকা বিরাট ফলপ্রসূ এবং আশাব্যঞ্জকও বটে। বলা হয়ে থাকে, যদি কোনো দেশ উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায়, তাহলে সে দেশে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কেন না, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং সরকারের শিল্পবান্ধব ভূমিকার মধ্যে নিরিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এক্ষেত্রে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের বিনিয়োগ নীতিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত দারিদ্র্যপীড়িত বৃক্ষমানব দেশ মালয়েশিয়াকে মাহাথির মোহাম্মদ মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ করালেন অগ্রগতির পাহাড়ের চূড়ায়। ডা. মাহাথির বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বা দাতা সংস্থার পরামর্শ এড়িয়ে নিজের চিন্তা-চেতনায় দেশের জন্য যা মঙ্গলকর তাই করেছেন। মাহাথির মোহাম্মদ মন্ত্রীদের কাছে ব্যবসায়ী সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চলমান থাকে। তাদের অভিযোগ ও প্রস্তাব শুনে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হয়। সে সময় মালয়েশিয়ায় উৎপাদন খাতের কোনো বিশেষজ্ঞ, পুঁজি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও বাজার বিষয়ে জ্ঞানও ছিল না। সে ক্ষেত্রে শিল্পায়নের একমাত্র উপায় ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প বিকাশকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে শক্তিশালী করা হলো। যারফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঘাড় নাড়ালেও মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ব্যাহত না হয়।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় যে পরিমাণ বিনিয়োগ হওয়া উচিত, সে তুলনায় দেশে বিনিয়োগ অনেক কম। বর্তমানে এই দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২৪ দশমিক ২০ শতাংশের মতো। বাস্তবিক পক্ষে দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগের পরিমাণ সে হার কেউ ছুঁতে পারেনি। অর্থনৈতিভাবে উন্নত দেশগুলো প্রধানত শিল্পকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে। এরফলে দেখা গেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে ঘটেনি। একারণেই প্রায় ২০০ বছর ধরে উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাঝে উন্নয়ন বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। অপরপক্ষে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশগুলোও শিল্পে উন্নত দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে- প্রাকৃতিক সম্পদ বিহীন জাপানের উত্থান আর সম্পদের প্রাচুর্যে ভরপুর বাংলাদেশের অনগ্রসর অবস্থার কথা বলা যায়।

এই অবস্থার আলোকে বলা যায় আমাদের দেশীয় শিল্প বিকাশ নীতি বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্প উদ্যোগ একটি সামাজিক, ব্যক্তিক, রাষ্ট্রীয় ও মনস্তাত্বিক বোধ পরিবর্তনের আন্দোলন। মধ্যযুগে ইউরোপের প্রটেস্ট্যান্ট এথিকস্ আন্দোলনের ফল ইউরোপের শিল্প বিপ্লব। পরবর্তীকালে সে পথ অনুসরণ করে উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশ। যারা ধন ও মানের পাশাপাশি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে সমীহ আদায় করতেও সমর্থ হয়েছিল। তাই শুধু কৃষিনির্ভর দেশ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বলে প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব হবে। কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প বিকাশ নীতিকে অগ্রাধিকারের মানসিকতায় নিয়ে আসার বিকল্প নাই। কেন না, শিল্পকে বিকশিত হতে না দিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বন্ধ হবে। ফলে সরকারের ওপর কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাপ বাড়বে। বাড়বে মাদকতা, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ, জঙ্গিবাদ, খুন, ধর্ষণসহ বহুবিধ অপরাধ কার্যক্রম। আর এসবের দায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসেবে সরকারের ওপর চাপবে। সেকারণে কোনো সরকার পরপর দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারে না। অথচ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যে কোনো সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন ৮-১০ বছরের নিচে সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে সরকারগুলো পরপর দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারেনা। এ কারণে সরকারের অনেক গৃহীত পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনা। সুফল পায় না দেশের মানুষ। পরবর্তী সরকার এসে এগুলোকে বাতিল করে দেয়।

মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে দেশে সঙ্গীত কনসার্ট হয়। অত্যন্ত হাস্যকর বিষয় হলো- কেন যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে, বিপথে যাচ্ছে- সেকারণটি খোঁজার চেষ্টা করা হয় না। কাজ পেলে, সমাজে আজ পরিচয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মেধাবি শিক্ষার্থীরা মাদকের মরণ ছোবলের কবলে পড়ত না। সুতরাং সবার আগে চাই সবার জন্য উপযোগী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। আর ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বলয়ে সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সফল হবে এবং একাজটি দেশীয় শিল্প বিকাশ ছাড়া অসম্ভব। সরকারের একক প্রচেষ্টায় একটি দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামোর পরিবর্তন সম্ভব নয়। যেমন সরকার চাইলেও পারে না ইচ্ছেমতো দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রতে রাখতে। ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হয়। আমাদের দেশে শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা অসদুপায় অবলম্বন করেন বললে পরিপূর্ণ সঠিক বলা হবে না। কেন না, প্রচলিত অনিয়মতান্ত্রিক জটিলতার ধারায় ব্যবসার ক্ষেত্রে নির্ধারিত পথ অবলম্বন করলেই অনেক নিয়ম ও আইনি জটিলতা এড়িয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি সীমারেখা অতিক্রম করলেও দোষের কিছু হয় না। এসব কারণে শিল্প উদ্যেক্তাদের দায় দেয়া যায় না। আমাদের প্রশাসনিক অবকাঠামো এবং ব্রিটিশ আইনগুলোকে যুগোপযোগী করাই বরং অধিক যুক্তিযুক্ত।

আমাদের দেশে অধিকাংশ শিল্প উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তিক বা সামষ্টিক প্রয়োজন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে। এখনো অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প উদ্যোগ বিকশিত হচ্ছে নিজেদের প্রচেষ্টায়, জনস্বার্থে। তাই এ ধরনের উদ্যোগকে আইনগত সীমাবদ্ধতার অজুহাতে আটকে দিলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন দূরূহ হবে। সরকারের কাজ আপন চেষ্টায় গড়ে ওঠা শিল্পকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। তার জন্য পৃথক আইন অথবা সংশোধিত আইন প্রণয়ন করা। নাগরিকরা যদি নিজেদের প্রচেষ্টায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়, সেটা তো সরকারেরই সহায়ক পদক্ষেপ। সরকার কোনো যুক্তিতেই এই সম্ভাবনার পথে বাধা হতে পারে না। বর্তমান সরকার যদি শিল্প উদ্যোক্তাদেও সঙ্গে বসে ১০ বছরের একটি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা উদ্যোগী হয়, সেটাই হবে দেশের সমৃদ্ধিও মূলমন্ত্র। দেশীয় শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শ্রমঘন শিল্প স্থাপন হতে পারে দিন-বদলের হাতিয়ার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত