ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রুচির দুর্ভিক্ষ

খাদিজা আক্তার
রুচির দুর্ভিক্ষ

‘পয়সার সঙ্গে সঙ্গে রুচি বলে একটি বস্তু নাকি চলে আসে। ডাহা মিথ্যা কথা, এই জিনিসটি সঙ্গে নিয়ে জন্মাতে হয়।’ কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদের এই কথার সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত নন, তবে এই কথার সঙ্গে একমত বা সহমত পোষণ করবেন, যারা তারাই সংখ্যায় বেশি হবেন সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ রুচি পয়সা দিয়ে কেনার বস্তু নয়। পয়সা হলেই যে মানুষের রুচির পরিবর্তন হবে তা কিন্তু নয়। কারণ ‘রুচি’ খুবই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। গরিবেরও রুচি আছে। গরিবের রুচি মানে নিম্নরুচি নয়, সে রুচিতে আছে সরলতা আছে স্নিগ্ধতা। ইদানিং ‘রুচি’ এবং ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দ দুটি নিয়ে আমার চিন্তার জগৎ শুধুই সরব হচ্ছে। এদেশে এখন খাদ্যের দুর্ভিক্ষ নেই। দুর্ভিক্ষ আছে রুচির। সহজে ভিক্ষা মিলে না যে অবস্থায়, তা যদি হয় দুর্ভিক্ষ তাহলে সে অবস্থা এখন আমাদের দেশে নেই। তবে যে চরম রুচির দুর্ভিক্ষে ভোগছে আমাদের এই সময়, এ প্রজন্ম তা শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের পথই প্রসারিত করছে। আমাদের ধর্মীয় কালচার দেশীয় কালচার সবই আজ হুমকির মুখোমুখি।

বাংলা অভিধানে রুচি শব্দের মানে হচ্ছে শোভা, দীপ্তি, পছন্দ, মার্জিত বুদ্ধি বা প্রবৃত্তি, স্পৃহা, ইচ্ছা ইত্যাদি। এখানে অনেকগুলো অর্থ আছে। কিন্তু রুচি নিয়ে প্রথম যেই ভাবনাটি মাথায় আসে তা হচ্ছে সুন্দর কিছু, ভালো কিছু, গ্রহণযোগ্য কিছু অর্থাৎ পজিটিভ কিছু। আজকাল আমরা যে রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি তা শুধু কুৎসিত ভবিষ্যতেরই ইংগিত দেয়। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ কিছুদিন আগে এই কথা বলে কারো কারো কাছে তুলোধুনো হয়েছেন আবার কেউ কেউ তার সঙ্গে সহমতও পোষণ করেছেন।

আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটি লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতীক হিসেবে হিরো আলমের নাম নেওয়ায় আপনি হয়তো মামুনুর রশীদের মুণ্ডপাত করতে পারেন, আবার তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আপনি হিরো আলমের মতো এমন শখানেক ফেসবুক আবর্জনাকে কথার তীর দিয়ে বিদ্ধ করতে পারেন। এটি আপনার রুচির বহিঃপ্রকাশ। হ্যাঁ, আমরা জানি মানুষ হিসেবে সবার ব্যক্তিগত রুচি বা অরুচি আছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের প্রাত্যহিক সময়ের সঙ্গে সেই অরুচি, কুরুচি মিশে একেবারে খিচুড়ি সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতি হয়ে যায়। হিরো আলম যাদের রুচিতে আছে তাদেরও একটা বিরাট শ্রেণি আছে। তারাই হিরো আলমকে তৈরি করেছেন এবং তারাই বাঁচিয়ে রাখবেন।

এই যে রুচির দুর্ভিক্ষের দুর্গন্ধ আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত চলে আসছে আর আমরা নাকমুখ বন্ধ করেও এই দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাচ্ছি না তার দায় কার? আমাদের সকলের। পরিবার থেকে রাষ্ট্র আমরা সকলেই এর জন্য দায়ী। সহজ যোগাযোগমাধ্যমে কিছু সস্তা সংবাদ মাধ্যম তাদের ভিউ বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আপনি দেখতে, শুনতে না চাইলেও আপনার মুঠোফোন আপনাকে এক মুঠো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে যাবে। আর এভাবেই ফেসবুক নামের এই জায়গাটি কলুষিত হচ্ছে। আসলে দুর্ভিক্ষ কীসে? রুচির দুর্ভিক্ষ নাকি সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ? ব্যক্তিগত রুচির অধপতনই আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটি একটু একটু করে ভয়ংকর রকমের কুৎসিত করে দিচ্ছে। স্কুল গোয়িং বাচ্চারাও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। ঘরে বসে ইউটিউব দিয়ে আয় হয় বলে অনেকেই দেদারসে ঝাঁপিয়ে পরছে সাত-পাঁচ না ভেবেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত