ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুঝুঁকি

ব্যবহার বিধি জানা ও সতর্কতার বিকল্প নেই
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুঝুঁকি

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। লাইনের গ্যাসের নতুন সংযোগ সীমিত করার কারণে মানুষ রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে এক একটি গ্যাস সিলিন্ডার ‘বোমার’ মতো মানুষকে আতঙ্কিত করছে। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো দরকার হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। সবশেষ গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩২ জন দগ্ধ হয়েছে এবং তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নয়। তার মধ্যে ৮০ শতাংশর বেশি বার্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ জন। আর ৯০ শতাংশ বার্ন আছে ১০ জনের বেশি রোগীর। তাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। রোগীদের সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। শিশুদের সাধারণত ১০ শতাংশের বেশি বার্ন হলেই মেজর হয়ে যায়। সেখানে প্রায় সবারই ৩০ শতাংশের বেশি বার্ন আছে। ভর্তিদের মধ্যে সাত শিশুর বয়স ১০ বছরের মধ্যে। আর ১১ থেকে ১৮ বছরের ছয়জনসহ মোট ১৩ জন শিশু বর্তমানে চিকিৎসাধীন। বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বিস্ফোরণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। গ্রামাঞ্চলে এ গ্রাহকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাজারে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি কোম্পানির অন্তত ২ কোটি সিলিন্ডার রয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বাজারে রান্নার জন্য যেসব গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়, সেগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। কারণ এলপিজি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তার চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি চাপ ধারণ করার ক্ষমতা এসব সিলিন্ডারের থাকে। তাই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো ঝুঁকিই নেই। তবে তারপরও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- সিলিন্ডারগুলো যথাযথভাবে পরিবহন, মজুত ও ব্যবহার না করা। সিলিন্ডারে দুর্ঘটনা মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভ ইত্যাদিতে দুর্বলতার কারণে যে কোনো সময় গ্যাস লিক হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে জমতে থাকে। সামান্য আগুন এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই জমে থাকা গ্যাসে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। সে কারণে সিলিন্ডার দুর্ঘটনার খবরে মানুষ বেশ আতঙ্কের মধ্যে থাকে। গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ কেনার সময় সত্যায়িত সার্টিফাইড কোম্পানি কিংবা অনুমোদিত বিক্রেতাদের থেকে কেনা উচিত বলে পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিস্ফোরণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে প্রথমেই দেখতে হবে সিলিন্ডারের গায়ে মেয়াদ দেয়া আছে কি না। সাধারণত একটি সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া থাকে। যেটা সাধারণত ১০ বছর থেকে ১৫ বছর হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সেইসঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, পাইপ রাবারের রিং, রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না- সেটা পরীক্ষা করে নিতে হবে। বাংলাদেশে প্রচলিত সিলিন্ডারগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও এর অনেক নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে আশঙ্কা রয়েছে। শুধু সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে- যদি এর পাইপ, রেগুলেটর খারাপ মানের হয়। এখানে বাজারে ভালো খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয়ে কমদামের মানহীন পণ্য কেনে। আবার অনেকে না জেনেই নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করছেন। আর সে কারণেই ঘটে বিপত্তি। সতর্কমূলক পরামর্শ হচ্ছে সিলিন্ডারটি টানা হেঁচড়া করে, ধাক্কা দিয়ে, মাটিতে গড়ানো যাবে না। বাংলাদেশের এলপিজি বিধিমালা, সিলিন্ডার বিধিমালা এবং বিস্ফোরণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আরো যেসব সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে- এলপিজি সিলিন্ডার খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। উপুড় বা কাত করে রাখা যাবে না। এমনভাবে রাখতে হবে যেন আশপাশে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে।

সিলিন্ডার কোনো পাটাতনের ওপরে নয় বরং মাটিতে সমতল পৃষ্ঠে রাখতে হবে এবং চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি উপরে রাখতে হবে। সিলিন্ডার কোনভাবেই চুলার-আগুনের খুব কাছাকাছি রাখা যাবে না। সিলিন্ডারটি লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে। সিলিন্ডার রান্নাঘরের চুলার নিচে, ক্যাবিনেটের ভেতরে কিংবা বদ্ধ অবস্থায় নয় বরং খোলামেলা জায়গায় এবং সমান ভূমিতে রাখতে হবে। যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে। তবে সরাসরি সূর্যের নিচে রাখা যাবে না। ছায়া যুক্ত শুষ্ক পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে হবে। সিলিন্ডার যেখানে থাকবে, সেখানকার একটি জানালা সব সময় খোলা রাখার চেষ্টা করতে হবে। না হলে ঘরের ওপরে ও নিচে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন চুলা চালু না থাকে। আগুন, বিদ্যুৎ এবং তাপের যেকোনো রকম উৎস সেইসঙ্গে দাহ্য, প্রজ্বলিত বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোনো গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে। যেখানে সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে, তার আশপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না। রান্না শুরু করার আধাঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে এবং রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অনেকদিনের বদ্ধ ঘরে প্রবেশের পর সবার আগে দরজা জানালা খুলে দিতে হবে। যদি ঘরের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে জানালা দরজা খুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

এই সময়ের মধ্যে ম্যাচের কাঠি জ্বালানো, ইলেকট্রিক সুইচ, সিলিন্ডারের রেগুলেটর কিংবা মোবাইল ফোন অন বা অফ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে সিলিন্ডারে লিকেজ খোঁজার সময় মোমবাতি কিংবা ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করেন। সেটা কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না। অতিরিক্ত গ্যাস বের করার জন্য এলপিজি সিলিন্ডারে চাপ দেয়া, ঝাঁকানো কিংবা সিলিন্ডার গরম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে তরল এলপিজি দ্রুত গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে অস্বাভাবিক চাপ বেড়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। এলপিজি পূর্ণ সিলিন্ডার কোনো দুই চাকার যান যেমন সাইকেল, মোটর সাইকেলে কিংবা ভারসাম্য কম, এমন বাহনে পরিবহন করা যাবে না। এছাড়া বছরে অন্তত একবার গ্যাস সিলিন্ডারটি এবং এর সঙ্গে ব্যবহার হওয়া নানা রকম সামগ্রীর নিয়মিত ডিস্ট্রিবিউটর বা সরবরাহকারী দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। সিলিন্ডারের ভালভ, গ্যাসের পাইপ বা ফিটিংস দুর্বল হলে কিংবা সিলিন্ডারে ছিদ্র থাকলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতে হবে। একে মেরামত, ঝালাই করে ব্যবহার করা যাবে না। তেল বা পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এরপরও যেকোনো ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যেমন- গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখা যেতে পারে। মোট কথা যে কোনো দুর্ঘটনা মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতন থাকার পাশাপাশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত