নিরাপদ সমুদ্রযাত্রায় জলদস্যুতা

উপকূলবর্তী দেশগুলোকে নিতে হবে সম্মিলিত পদক্ষেপ

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমুদ্রযাত্রায় জলদস্যুতা মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিরাপদ ও স্বল্প খরচের কথা বিবেচনা করে মানুষ সমুদ্র পথকেই বেছে নেয়। তবে কখনো কখনো সমুদ্রযাত্রা অনিরাপদ হয়ে উঠে। বিশেষ করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা যখন বেপরোয়া হয়ে উঠে, তখনই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়। সোমালিয়ার জলদস্যুরা কখন কোন দেশের জাহাজের ওপর আক্রমণ চালাবে, সেটি কারো পক্ষে আগাম ধারণা করা সম্ভব নয়। সে কারণে এই উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে উপকূলবর্তী দেশগুলোকে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব হবে না। সোমালিয়ার জলদস্যুরা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ জন নাবিককে জাহাজসহ জিম্মি করার পর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাহাজটি উদ্ধার ও জিম্মিদের সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জিম্মি নাবিকদের আত্মীয়-স্বজন উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। রমজান মাস চলছে। ঈদ আসছে। ঈদের সময় নাবিকরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাবেন। আবার নাবিকদের মধ্যে কেউ কেউ ঈদে বাসা-বাড়িতে আসবেন। স্বাভাবিক কারণে ঈদের সময় নাবিকদের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ওই সব নাবিক আটক হওয়ার পর, তাদের পরিবারে বিষাদ নেমে এসেছে। তাদের পরিবারের লোকজন প্রতিনিয়ত আহাজারি করছে। তারা অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন, কখন কীভাবে নাবিকরা মুক্তি পাবে। তবে কবে নাগাদ নাবিকরা দেশে ফিরে আসতে পারবে, সেই নিশ্চয়তা এই মুহূর্তে কেউ দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ সরকার ও জাহাজটির মালিকপক্ষ কারো সঙ্গে জলদস্যুরা যোগাযোগ করেনি। ফলে তাদের দাবি-দাওয়ার কথার কথা জানা যাচ্ছে না। জাহাজসহ জিম্মি নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে তৃতীয়পক্ষ জাহাজটির বিমাকারী যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে জাহাজের মালিকপক্ষ। তবে এ জন্য কত দিন সময় লাগতে পারে তা অনিশ্চিত। তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে জাহাজের নাবিকরা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। জলদস্যুরা নাবিকদের কোনো ক্ষতি করেনি। ‘এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর একই মালিকের জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’ একই জলদস্যু বাহিনীর কবলে পড়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও হয়তো সব নাবিককে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগের জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সর্বশেষ গত ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। বেশ কয়েক বছর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে সোমালি জলদস্যুরা। লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গাল্ফ অব এডেনে সোমালি জলদস্যুরা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমালিয়ায় কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এ সময়ে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্ট গার্ড বা বাহিনীও ছিল না। ফলে এ অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেন না, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি। তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে সোমালীয়দের দস্যুবৃত্তি। পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে সামুদ্রিক নিরাপত্তায় কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী। তাদের হিসাবে, গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালিয়া উপকূলে অন্তত ১৪টি জাহাজ ছিনতাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার নৌকা এবং লাইবেরিয়ান পতাকাবাহী সেন্ট্রাল পার্ক নামে একটি জাহাজের জেলে ও নাবিকদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করা হয়।

গত জানুয়ারিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এক সপ্তাহে তিনটি অভিযানে ১৯ জন জিম্মিকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় তারা। তাদের মধ্যে ১১ জন ইরানি নাগরিক, বাকিরা পাকিস্তানি। ভারতীয় বাহিনীর তরফে জানানো হয়, এদের সবাই সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন। বিবিসি’র রিয়েলিটি চেক টিমের প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকান জলসীমায় ১১২টি নৌ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আর সবশেষ শিকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে ২৩ জন ক্রুসহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা। দস্যুরা স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। তারা নিরাপত্তাবাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে নানাভাবে। এবার পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগায় তারা। এমনটাই মনে করছেন রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন। তিনি জানান, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে জলদস্যুতা বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে। সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় পশ্চিমা বাহিনীগুলোকে সেদিকে বেশি নজর দিতে হয়েছে। সামরিক দিক থেকে বিচার করলে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোনের আক্রমণ মোকাবিলা করা এখন বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। সে কারণে ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র সামাল দিতে গিয়ে জলদস্যুদের দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। ত্রিকোণাকৃতির ভৌগোলিক মানচিত্রের কারণে পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলকে হর্ন অব আফ্রিকা বলা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত হর্ন অব আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে, তার একটি হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে ৩৫০ থেকে ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল জানিয়েছেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় বলেই ধারণা করা যায়। অন্তত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নেপথ্য এটিই মূল কারণ। ২০১১ সালে একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করে দস্যুরা। ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জ্বালানি ছিল নৌযানটিতে। আটক দুই ফিলিপিনো ক্রুকে হত্যা করা হয়। পূর্ব আফ্রিকান জলদস্যুতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওয়েওল বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহুজাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতায় দস্যুদের প্রতিহত করা সম্ভব হয়। সুতরাং, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য সবসময় পুরোপুরিভাবে জানা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৭ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। জলদস্যুরাও ঝটিকা আক্রমণ চালায়। প্রায়ই রাতের অন্ধকারে হাজির হয় তারা। তাই ক্রুরা ঘটনা বুঝে উঠতে উঠতেই দেরি হয়ে যায়। একবার জলদস্যুরা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তাতে জিম্মিদের হতাহত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। গভীর সমুদ্রে আটক জলদস্যুদের বিচারের মুখোমুখি করতে জটিলতার কারণে কখনো কখনো ছেড়েও দেওয়া হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি রেজুলেশন রয়েছে, যাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দেশগুলোকে সোমালি জলসীমায় দস্যুদের ধরার অনুমতির কথা বলা রয়েছে। ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা বলছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের ভাষ্য, ওই এলাকায় নিয়োজিত অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় দস্যুবৃত্তির পুনরুত্থান ঠেকাতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এসব বাহিনীর সাফল্যও কম নয়। ইউরোপীয় নৌবাহিনীর পাশাপাশি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতি অনেক দস্যুতার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। কিন্তু আইওসির অভিযোগ, ইইউন্যাভ বর্তমানে স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি মাত্র জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য নৌবাহিনীগুলোর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়েছে। সোমালি দস্যুদের মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দুটি ভূরাজনৈতিক সংঘাতের দিকে নজর দিতে হবে।