ভোগবাদী দুনিয়ায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের আন্তরিক হতে হবে

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভোগবাদী দুনিয়ায় আমরা আজ অসহায় ক্রেতা মাত্র। আমাদের আকাঙ্ক্ষাও আজ পণ্যায়িত। সাম্প্রতিক বৈশ্য যুগে বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষত টিভি চ্যানেলগুলোয় চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের চাহিদাকে অনন্ত করে তোলা হচ্ছে। আমরাও উৎপাদক কোম্পানিগুলোর মনোহর বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিচ্ছি ‘কলগেট ভোর থেকে ফিলিপ্স রজনী’ অবধি। যে কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য আমরা ক্রয় করছি নিকটবর্তী কোনো দোকান থেকে, সেই কোম্পানি দোকানদারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য ওয়ারেন্টি দিচ্ছে। ওয়ারেন্টি মানে চুক্তি। এই ওয়ারেন্টির মাধ্যমে কোনো পণ্যের উৎপাদনকারী কোম্পানি বিক্রিত পণ্যের জন্য ক্রেতার সঙ্গে এই চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে যে, যে-সময়সীমার জন্য ওয়ারেন্টি দেয়া হলো, সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আগে বিক্রিত পণ্যটিতে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে, ব্যবহারের অনুপযুক্ত বা নষ্ট হয়ে গেলে উৎপাদক কোম্পানি নিজের খরচে পণ্যটি সারিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে ক্রেতার হাতে পুণরায় ফেরত দিতে বাধ্য। যদি বস্তুটিকে সারিয়ে তোলা না যায়, তাহলে নষ্ট বস্তুটির পরিবর্তে ওই দামেরই নতুন ও ভালো আরেকটি বস্তু ক্রেতাকে বিনামূল্যে দিতে বাধ্য। কারণ, উপভোক্তা ওই বস্তুর ঠিকঠাক পরিসেবা পাওয়ার জন্য কোম্পানিকে টাকা তো দিয়েই দিয়েছে।

কথাগুলো শুনতে আপাতত খুব ভালো লাগলেও বাস্তবে এর ভেতরে যথেষ্ট জটিলতা রয়েছে। নতুন পণ্য ক্রয় করে ওয়ারেন্টি কার্ড ও রসিদ হাতে নিয়ে আমরা হাসিমুখে ঘরে ফিরি। কিন্তু সেই হাসিমুখ অনেক সময় কালো হয়ে যায়। ধরা যাক, আপনি আপনার নিকটবর্তী কোনো দোকান থেকে একটি নামি-দামি কোম্পানির ব্যাটারিসহ ইউপিএস বা ইনভারটার কিনে নিয়ে এলেন। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে আপনার কাজকর্ম বা আপনার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। আলো নেই, ফ্যান ঘুরছে না, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার করা যাচ্ছে না, ইন্টারনেটে জরুরি যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, ঘরের অসুস্থ রোগীকে অন্ধকারে আলোহীন থাকতে হচ্ছে, টয়লেটে যাওয়া যাচ্ছে না, গিন্নি লাইট ছাড়া রান্নাবান্না করতে পারছেন না, পরিবারের সদস্যরা টিভি দেখতে পারছেন না। আরো কত রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আপনার একমাত্র লোডশেডিংয়ের জন্যই। এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতেই তো আপনার ইনভারটার বা ইউপিএসসহ ব্যাটারি কেনা। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই আপনি লক্ষ্য করলেন, আপনার ব্যাটারিটি ডাউন হয়ে গেছে। কেনার পর প্রথম দিকে লোডশেডিংয়ের সময় যেখানে আপনার ইনভারটার বা ইউপিএসটি ফ্যান, লাইট, টিভিকে এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা ঠিকঠাকভাবে চালু রাখতে পারত, সেখানে ১৫ মিনিট পরেই ইউপিএসটি ব্যাটারি লো দেখাচ্ছে, আর টিটি করে আপনাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। এমতাবস্থায়, যে দোকান থেকে আপনি ব্যাটারি ও ইনভারটার কিনেছিলেন সে দোকানে ছুটলেন হন্তদন্ত হয়ে। আপনার ওয়ারেন্টি আঠারো মাসের, তাই ব্যাটারি বিনামূল্যে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব সেই দোকানসহ কোম্পানির। দোকানি বলল, ব্যাটারিটি সারাইয়ের জন্য ঢাকায় কোম্পানির সার্ভিস সেন্টারে পাঠাতে হবে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, কেন? কোম্পানি গোটা সিলেটে বিভিন্ন ডিলারের মাধ্যমে বাজারজাত পণ্যটি বিক্রি করছে, অথচ সার্ভিস সেন্টার রেখেছে ঢাকায়। এমনটি হবে কেন? চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মন ভুলাব, ওয়ারেন্টি দেব, পণ্য বিক্রি করব, অথচ আপনার নিকটবর্তী কোনো জায়গায় সার্ভিস সেন্টার রাখব না- এ কেমনতর কথা? যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না? মাছ ধরব অথচ পানি ছোঁব না। এই কি কোম্পানিগুলোর তলপেটের কথা?

কথা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরো আছে। আপনি যে দোকান থেকে ব্যাটারি কিনেছিলেন, সেই দোকানের মালিক আপনাকে বলল, ব্যাটারিসহ আপনার ওয়ারেন্টি কার্ডটি নিয়ে আসুন দোকানে। আপনি একজন ইলেকট্রিশিয়ানকে ডাকলেন। তাকে আপনার পকেট থেকে টাকা দিয়ে ইনভারটারটি ডিসকানেক্ট করালেন। তারপর আপনার পকেটের টাকা খরচ করে রিকশা বা অটোভাড়া দিয়ে ব্যাটারিটি দোকানে নিয়ে গেলেন। দোকানি আপনার এসব খরচের টাকা দেবে না। আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার-করা টাকা বিনা দোষে খরচ হয়ে গেল। এই খরচের দায় কেউ নেবে না। অথচ কোম্পানি তো আপনাকে ওয়ারেন্টি দিয়েছে যে, সে নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতরে বিনামূল্যে ঠিকঠাক করে দেবে। তা হলে মাঝখানের এই খরচের দায়ও কোম্পানিরই থাকা উচিত। সে তার নিজ দায়িত্বে বস্তুটি আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে, আবার ঠিকঠাক অবস্থায় সে আপনার বাড়িতে ফেরত দেবে, কারণ, বস্তুটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যে আপনি দায়ী নন। তা ছাড়া কোম্পানি এ-কাজ করে দিতে আপনার সঙ্গে আগেই চুক্তিবদ্ধ। আমাদের সচেতনতার অভাবে আমরা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলি না, তাই বিনা দোষে আমাদের পকেটের টাকা অন্যের পকেটে চলে যায়। আর কোম্পানি তার মুনাফা আদায় করতে একটুও পিছ পা হয় না।

এবার দেখুন, ব্যাটারি ও ওয়ারেন্টি কার্ডটি দোকানে নিয়ে যাওয়ার পর দোকানি আপনাকে বলল, রেখে যান ব্যাটারি ও ওয়ারেন্টি কার্ড। আমি ঢাকাতে সার্ভিস সেন্টারে পাঠাব। আপনি যদি সচেতন গ্রাহক হন, তা হলে অবশ্যই দোকানির কাছ থেকে ওয়ারেন্টি কার্ড ও ব্যাটারিটি জমা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত রসিদ চেয়ে নেবেন। সে-রসিদ দিতে দোকানি আইনত বাদ্য। অনেক সময় কোনো কোনো ক্রেতা দোকানির কাছ থেকে সেই রসিদটিও নেন না, কারণ তার মুখের মিষ্টি কথার ওপর বিশ্বাস করেন। অথচ বিশ্বাস যে শেষ পর্যন্ত টিকবে তার গ্যারেন্টি কে দেবে? এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অনেক সময় কিছু কিছু ক্রেতাকে যে নানাভাবে ঠকাবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? ধরা যাক, দোকানদারটি আপনাকে উপযুক্ত রসিদ দিল। বলল, আজই আমি আপনার ব্যাটারিটি মেরামতের জন্য কিংবা পরীক্ষা করে দেখার জন্য ঢাকা সার্ভিস সেন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, কত দিনের ভেতর আমি ব্যাটারিটি ফেরত পাব? দোকানি বলল, যে-দিন কোম্পানি ফেরত দেবে। ফেরত দেবার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দোকানি আপনাকে দিল না। রসিদেও ডেট অব ডেলিভারি লিখে দিল না। এমতাবস্থায়, আপনাকে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করতে হবে। এক মাস, দু’মাস কিংবা তিন মাস পরেও আপনি ব্যাটারিটি ফেরত পেতে পারেন। এহেন অসহায় অবস্থায় আপনি দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, যতদিন ব্যাটারিটি ফেরত পাচ্ছি না ৩০ দিন আমি চলব কীভাবে? দোকানি আপনাকে সান্ত¡না দেয়া ছাড়া আপাতত চলার মতো বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করে দেবে না। অন্তবর্তী কালে আপনার ঘরে লোডশেডিংয়ের সময়ে আলো জ্বলল না পাখা ঘুরল না, টিভি চলল না, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ থাকল, ইন্টারনেট ব্যবহার করা গেল না, রান্না-খাওয়ার অসুবিধে হলো। অথচ এসব সমস্যা দূর করতেই তো আপনি ব্যাটারি ও ইর্ন্ভাটার কিনেছিলেন। পুঁজির পাহাড়কে আরো উঁচু করে তুলেছে, ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়িয়েছে। আপনার টাকা ব্যাংকে জমা রেখে সে-টাকার ওপর সুদ পাচ্ছে কোম্পানি। অথচ অনির্দিষ্টকালের জন্য আপনাকে অন্ধকারে রাখছে, সমস্যার সাগরে ডুবিয়ে মারছে। এসব সমস্যা আপনার টেনশন বাড়াচ্ছে, রক্তচাপ বাড়াচ্ছে, সুগার বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে আপনার স্বাস্থ্যের দারুণ ক্ষতি হচ্ছে। অথচ কোম্পানি আপনার এসব ক্ষতিসাধন করে নির্বিকার থাকছে। এই হচ্ছে পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীদের মুখোশের আড়ালে আসল মুখের চেহারা। এই চেহারার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত নই। অথচ এ তো বাস্তব। এরকম তো চলতে পারে না। আপনি আপনার বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য টাকা দিয়ে ওয়ারেন্টিসহ বস্তু কিনেছেন কোম্পানির কাছ থেকে। ওয়ারেন্টির সময়সীমা পর্যন্ত আপনার ওইসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কোম্পানিরই নেয়া ব্যাটারিটি মেরামতের জন্য আপনি একটি যুক্তিসম্মত সময় কোম্পানিকে দিতে পারেন। অনির্দিষ্ট সময় নয়। আর অন্তবর্তীকালীন বিকল্প ব্যবস্থায় দায়িত্ব নেওয়া উচিত কোম্পানিরই। কিন্তু কোম্পানি যদি সে-দায়িত্ব না নেয়, তা হলে ওয়ারেন্টির মূল স্পিরিটটি বজায় থাকল কি? সে ক্ষেত্রে কী মূল্য আছে ওই ওয়ারেন্টির? এর মাধ্যমে আংশিকভাবে হলেও কোম্পানি কি ক্রেতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না।

আমরা এ রকম চলাকেই প্রথা বলে মেনে নিচ্ছি বিনা প্রতিবাদে। সচেতনতার অভাবে জানতেই চাইছি না যে, এসবের জন্যেও আইন রয়েছে। সব রকম ধোঁকাবাজি, বঞ্চনা ও ক্ষতির জন্য আইনি ব্যবস্থারও শরণাপন্ন হওয়া যায়। ক্রেতা বা গ্রাহক টাকা দিয়েছেন, অথচ ওই টাকার বিনিময়ে যে পরিষেবা তার প্রাপ্য তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন- এরকম হলে কনজিউমার্স ফোরামে বিচারের জন্য মামলা করতে পারেন। গ্রাহক ও ক্রেতার অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা আইনেই রয়েছে। ওয়ারেন্টির নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতরে ক্রয়-করা কোনো একটি পণ্যের মেরামতের জন্য রসিদে কোনো নির্দিষ্ট সময় দেয়া না- থাকলেও আইন আইনের পথেই চলবে। কোর্ট ঠিক করবে ওই বস্তুটি মেরামতের পরীক্ষা করে দেখার জন্য কতটুকু সময় লাগা উচিত। এই সময়ের ভেতর যদি গ্রাহক বস্তুটি ফেরত না- পান তা হলে ক্রেতা বা গ্রাহক বিধিসম্মতভাবে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। যে-ব্যবসায়ী বা কোম্পানি ক্রেতা বা গ্রাহকের ক্ষতি করেছে, তার জন্য সেই ব্যবসায়ী বা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে আইনত বাধ্য। প্রতিটি পণ্যের ওয়ারেন্টির ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য। ধরুন, আপনি রেলের টিকিট কাটলেন, বার্থ রিজার্ভেশন বরলেন। রিজার্ভেশনটি কনফারমড। কিন্তু রেলে যাওয়ার সময় আপনি রির্জাভ বার্থটি পেলেন না। সে ক্ষেত্রেও রেলের বিরুদ্ধে আপনি কনজিউমার্স ফোরামে উপযুক্ত প্রমাণপত্রসহ মামলা করতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে রেল আপনার সংশ্লিষ্ট সব ক্ষতিপূরণ দিতে আইনত বাধ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আমাদের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন? আমরা কি ক্রেতা বা গ্রাহক হিসাবে ক্ষতির জন্য কনজিউমার্স ফোরামের শরণাপন্ন হয়ে আইনি লড়াই করতে রাজি থাকি? আমাদের প্রতিবাদী মানসিকতার অভাবে, আইনি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অসাধু ব্যবসায়ী ও উৎপাদক কোম্পানিগুলোর বঞ্চনা ও কাঠামোর শিকার হচ্ছি। প্রতিটি জেলা ও দায়রা আদালতে কনজিউমার্স ফোরাম রয়েছে; সে খবর আমরা অনেকেই রাখি না। সেই অজ্ঞতার জন্যও অনেক সময় আমরা ক্রেতা ও গ্রাহক কোনো বিধিসম্মত ক্ষতিপূরণ পাই না। ক্রেতারা যতই সচেতন হবেন, ততই কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী ও উৎপাদক কোম্পানিগুলোর কান খাড়া হবে। প্রতারণা ও বঞ্চনার হার কমবে। ওয়ারেন্টি নামক চুক্তির জটিলতায় হাবুডুবু খেতে হবে না। প্রশ্ন এই, আমরা কোনোদিন কি যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠব? ন্যায্য অধিকার সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে শিখব?

সাংবাদিক-কলামিস্ট