বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার জীবনাচরণ

অনুস্মরণ করতে হবে এ প্রজন্মের শিশুদের

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের জন্য এক মহান অনুপ্রেরণা। তার শৈশব ও কৈশর জীবনকে যদি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ধারণ করতে পারে, তাহলে তাদের পরবর্তী জীবন হবে আদর্শিক ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে অনুস্মরণ ও অনুকরণ করার মধ্য দিয়ে আজকের শিশু-কিশোর আগামী দিনে জাতির জন্য মূল্যবান নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। শিশু-কিশোর জীবনে বঙ্গবন্ধু যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, সেভাবেই এ যুগের শিশু-কিশোরদের গড়ে তুলতে পারলে তারা আগামী দিনে পথভ্রষ্ট হবে না এবং তারা একজন আদর্শিক নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে। শুধু শিশু-কিশোর বয়স নয়, বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনই আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তবে আমাদের সন্তানরা সেই শিক্ষা যত বেশি আয়ত্ব করতে পারবে, তাদের জীবন তত বেশি সফল হবে। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা ছিল যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ। ছোটবেলার ‘খোকা’ ছিলেন এক দূরন্ত বালক। গ্রামের কাদা-জল, মেঠোপথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবতাবাদী। সেই সঙ্গে অধিকার আদায়ে আপসহীন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থ এবং বিভিন্ন লেখক ও গবেষকদের লেখনীতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’। বঙ্গবন্ধু নিজে ‘দুষ্ট বালক’ ছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনিই উল্লেখ করেছেন। কন্যা শেখ হাসিনা তার এক লেখায় বলেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তার ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করত। এই পোষা পাখি, জীব-জন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। খেলাধুলা, পাখি ধরা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও তিনি সে সময় বাড়িতে খুব পড়াশোনাও করতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি নিয়মিতই পড়তেন। বাড়িতে বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাঁত। এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার মাত্রই এসব পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন। ছোটবেলা থেকে এসব পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে ছোট্ট মুজিবের সামনে বিপুলা পৃথিবীর এক দরাজ দরজা খুলে গিয়েছিল’। কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’ শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। স্বভাবে দুরন্ত হলেও ছোটবেলায় নানা রোগও তাকে কম ভোগায়নি। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা হওয়ায় চিকিৎসা নিতে হয়েছিল কলকাতায়। অস্ত্রোপচারের পর চোখে উঠেছিল চশমা। চোখের অসুখের কারণে বেশ কিছু দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পরে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। যে বয়সটা দুরন্তপনার, সে সময়ই সংসার জীবনে পা রাখতে হয়, শেখ মুজিবুর রহমানকে।

ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেনুর বাবা-মারা যাওয়ার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সব সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ স্বদেশি আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারা জীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির ভক্ত ছিলেন। গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের। ছেলেবেলাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ তার সারা জীবনেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে এটা খুব বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় তার নেতৃত্বে। ওই অনুষ্ঠানে আলাপের পর শেখ মুজিবের নামণ্ডঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। পরে কিশোর মুজিবুর রহমানকে চিঠিও লেখেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরু-শিষ্যের এক অনন্য যুগলবন্দি। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু মানবদরদি ও হৃদয়বান ছিলেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করত। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসত। আর সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায়, আব্বা তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি, আব্বার জন্য মাসে কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ আর কিছুই নয়, কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ, রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাকে ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝেমধ্যে দিয়ে আসতেন। দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’ বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রোববার থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে সেই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গীরও ঠিক করে দিতেন। বঙ্গবন্ধুও তার সহযোগী হিসেবে এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। পরে হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষক মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেবা সমিতির ভার নেন এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আরেক শিক্ষক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কথাগুলো বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু এভাবে নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। সে কারণে বঙ্গবন্ধু আজকের প্রজন্মের জন্য আদর্শিক একজন প্রাণপুরুষ।