ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রবীণ জীবনে সংকট বাড়ছে

হাসান আলী
প্রবীণ জীবনে সংকট বাড়ছে

কেউই চান না জীবনের শেষদিনগুলো অসম্মান, অমর্যাদা, অনুগ্রহ, কৃপায় অতিবাহিত করতে। সবাই চান পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক প্রবীণ জীবন। শুধু চাইলেই এমন জীবন পাওয়া যাবে? অবশ্যই না। সম্মানজনক-স্বস্তিদায়ক প্রবীণ জীবন তৈরিতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বার্ধক্য ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। তারপরও বার্ধক্য ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। বার্ধক্যের মোকাবিলা ব্যক্তিকে করতে হয় বিধায় এর চ্যালেঞ্জ গ্রহণও ব্যক্তির ওপর বর্তায়। ব্যক্তি সমাজের অংশ এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অংশ। ব্যক্তির সক্রিয় ভূমিকায় প্রবীণ বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবনায় গুরুত্ব পেতে পারে। সরকার ও সমাজ প্রবীণ বিষয়ে অনেকদিন ধরেই চিন্তাভাবনা করছে। প্রবীণ জীবনের কষ্ট লাঘবে বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়েছে। প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণীত হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, দাম্পত্য জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কমবেশি চিন্তাভাবনা রয়েছে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সে বিষয়ে নানা ধরনের স্বপ্ন রয়েছে। শুধু প্রবীণ জীবনকে নিয়তির কাছে সমর্পণ করেছি। ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে- এই নীতি মেনে চলার প্রবণতা রয়েছে। শিক্ষাজীবনকে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ করতে স্কুলে যাওয়ার বয়স না হতেই স্কুলে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। গৃহশিক্ষক, কোচিং, স্কুলের পড়ার চাপ শিশু মোকাবিলা করে চাকরি জীবনে প্রবেশের সনদ জোগাড় করে। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে ব্যক্তির ২৭-২৮ বছর বয়স হয়ে যায়। চাকরি বা ব্যবসায় ঢুকতে অনেকেরই বয়স ৩০ বছর হয়ে যায়। কেউ কেউ ২০ বছর বয়সে চাকরি বা ব্যবসায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। তবে এ সংখ্যাটা অনেক কম। আবার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার দিনদিন বাড়ছে। পরিকল্পনাহীন উচ্চশিক্ষা যেমন সম্পদের অপচয়, একই সঙ্গে অদক্ষ-অযোগ্য উচ্চশিক্ষিত মানুষ সমাজের বোঝা। যারা চাকরি কিংবা ব্যবসার সুযোগ পান, তারা উলকার গতিতে প্রবীণ হয়ে যান। স্বপ্নের মতো ৩০টি বছর পার করে দেন। আয়নায় পাকা চুল দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। চুলে কলপ লাগিয়ে বার্ধক্যের চিহ্ন মুছে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হন। পড়ে যাওয়া দাঁতের স্থানে নকল দাঁত লাগিয়ে হাসেন। মুখের বলিরেখা মুছে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের ক্রিম মাখেন। আসন্ন বার্ধক্যকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি যৎসামান্য লক্ষ করা যায়। ৩০ বছর আয়-রোজগার করা এবং সক্ষম থাকার জন্য প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতি নিতে হয়। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে, জ্ঞান অর্জন করছে। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি লাভ এবং তুলনামূলক উন্নত জীবনযাপন করার স্বপ্ন। চাকরিজীবনে মানুষ সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অনেকে নিজের পদণ্ডপদবি আঁকড়ে থেকে চাকরিজীবন পার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চাকরিজীবনের আয় থেকে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে সহযোগিতা করেন অনেকেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ব্যবসার উন্নতির জন্য দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন। কর্মজীবনকে অর্থবহ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য মানুষ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কর্মজীবনে একজন কর্মী যাতে কাঙ্ক্ষিত, প্রকৃত উন্নতি করতে পারে, সেজন্য রয়েছে নিরলস প্রচেষ্টা। দাম্পত্য জীবনকে সুখী করার জন্য মানুষ সর্বোচ্চ ছাড় দেয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। দাম্পত্য জীবনকে ধরে রাখার জন্য মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্যও প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় মা-বাবা, ভাইবোনকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে দেখা যায়। সামাজিক জীবন মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তার কাজের প্রশংসা শুনতে চায় এবং স্বীকৃতি চায়। মানুষ সব ধরনের কষ্ট করতে রাজি হয়, যদি সে নিশ্চিত থাকে প্রশংসা, স্বীকৃতি, সম্মান পাবে। মানুষ সামাজিকভাবে সম্মান, মর্যাদা, ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে চায়। সামাজিক জীবনকে অর্থবহ করার জন্য আর্থিক, শারীরিক ত্যাগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। দার্শনিকরা বলেন, মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি সমাজের চালিকাশক্তি। মানুষ যত কর্মকাণ্ড করে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনীতি। রাজনীতির মাধ্যমেই মানুষ সমাজে শৃঙ্খলা আনে, সমাজের উন্নয়ন ঘটায়, পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামনে এগিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের চেহারা পালটে দেয়। আবার এ রাজনীতির জন্য মানুষ সর্বস্ব হারায়। মানবিক বিপর্যয় ঘটে দেশে দেশে। দুঃসহ যন্ত্রণা, নিপীড়ন, অত্যাচার আর মৃত্যু মানুষকে হতবিহ্বল করে দেয়। মানুষ এসব বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকে। ছেলেমেয়ের বিয়ে, বাড়িঘর তৈরি, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে। মানুষের সব অনীহা শুধু প্রবীণ জীবনকে নিয়ে। বার্ধক্য যে চলমান জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি অনেকে মনেপ্রাণে মানতে চায় না। প্রবীণ জীবন কেমন আনন্দের হবে, তা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে নারাজ। বর্তমান প্রবীণ জীবনের সংকট, দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল রয়েছে। সেই দুঃখ-কষ্টকে জয় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে বেশির ভাগ মানুষ বিষয়টি নিয়তির ওপর ছেড়ে দেয়। আবার কেউ কেউ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন ও পরিচর্যা পাওয়ার আশা করে। উন্নয়নশীল দেশে ৬০ বছর বয়স হলেই মানুষকে প্রবীণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশেও তা-ই।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। যারা ৭০, ৮০ ও ৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচবেন, তাদের অধিকাংশই বাকি ২০-৩০ বছরের প্রবীণ জীবনকে নিয়ে কার্যকর কোনো ভাবনা এখনো ভাবেননি। যারা পেনশনভোগী তারা ভাবেন-মাসে মাসে টাকা পাবেন, এতেই জীবন ভালো কাটবে, কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না। ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশায় সামর্থ্যবানরা ভাবেন-বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে, তেমন সমস্যা হবে না। দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন, যারা সহায় সম্বল ছাড়াই প্রবীণ জীবনে পা দিয়েছেন কিংবা দিতে যাবেন।

নিয়তি এবং সন্তানের ওপর ভরসা করে প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করা কতখানি যৌক্তিক, তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার সময় এসেছে। সামাজিক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ৭৬ শতাংশ তরুণ মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করে। এ থেকে বোঝা যায়, তরুণদের সঙ্গে মা-বাবার শিথিল সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় প্রবীণ জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার কাছে মানুষ পরাস্ত হয়ে গেছে। মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ যখন ভয়ংকর প্রশ্নের সম্মুখীন, ঠিক সেসময় প্রবীণদের সন্তানের ওপর ভরসা করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। আগে মানুষ প্রবীণ জীবন তেমন একটা পেতেন না। যারা পেতেন, তারা সমাজে অনেক বেশি সম্মান পেতেন। এখন ৮০ বছর পার করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে গড় আয়ু ৮০ বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব প্রবীণ টাকার ওপর ভরসা করে প্রবীণ হয়েছেন, তারা নিজেদের সেবাযত্ন অনেক সময় টাকা দিয়ে পান না। টাকার বিনিময়ে একজন পেশাদার সেবাকর্মী পাওয়া সহজসাধ্য নয়। পরিবারের সদস্যদের সেবাকর্মী নিয়োগে গড়িমসি একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো সামর্থ্যবান প্রবীণরা লোভী সেবাকর্মীর হাতে নাজেহাল হন, এমনকি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করেন। নিয়তি কিংবা সন্তাননির্ভরতার ভাবনা নিয়ে প্রবীণ জীবনে প্রবেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। যারা এখনো যৌবনে আছেন কিংবা প্রবীণ হননি, তারা বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় মানবিক অনেক বিষয় উপেক্ষিত হবে, এটি স্বাভাবিক। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন হয় মুনাফার জন্য। যেখানে মুনাফা নেই, সেখানে বিনিয়োগ হবে না। এরকম সমাজব্যবস্থায় সব ধরনের সেবা পণ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রবীণ সেবাও একটি পণ্য, এটি কিনতে হবে। যার সামর্থ্য আছে তিনি কিনবেন, আর যার সামর্থ্য নেই তাকে রাষ্ট্র কেনার জন্য সহযোগিতা করবে। পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে প্রবীণ সেবাকেন্দ্র, প্রবীণ নিবাস, প্রবীণ নার্সিং হোম, প্রবীণ দিবাযত্ন কেন্দ্র, প্রবীণ ক্লাব গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রবীণরা প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সেসব প্রতিষ্ঠান যারা গড়ে তুলবেন, তাদের সরকার আর্থিক প্রণোদনা দেবে। কারও দয়া, অনুগ্রহ, কৃপার ওপর প্রবীণ জীবন ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত