ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আত্মহত্যা নতুন এক সামাজিক ব্যাধি

জীবন বিসর্জনে দুনিয়া ও আখিরাতে ঘটে বিপর্যয়
আত্মহত্যা নতুন এক সামাজিক ব্যাধি

ইদানীং আমাদের সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আগে মানুষ অভাবের তাড়নায় কিংব ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করত। কিংবা বড় ধরনের কোনো আঘাত পেয়ে আত্মহণের পথ বেছে নিত। সকল ক্লান্তি ও দুঃখবোধ থেকে চিরতরে রেহাই পাওয়ার জন্য মানুষ আত্মহত্যা করত। আগে যারা আত্মহত্যা করতেন তারা অনেক ভেবে চিন্তে আত্মহত্যা করলেও এখন কেন যেন আত্মহত্যা একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে দিন দিন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। মানুষের জীবন সংক্রাম চিরদিনের জন্য। আজীবন লড়াই করার মন মানসিকতা নিয়ে মানুষকে পথ চলতে হয়। সামান্য কোনো কিছুতে ভেঙে পড়া কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না। জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আসবে, সেটা মোকাবিলা করে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের ব্যর্থতা কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। এটা সাময়িক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংকট কেটে যায়। সমস্যার সমাধান হয়। মানুষ আত্মতৃপ্তি লাভ করে। আত্মহত্যার অর্থ হচ্ছে জীবনের চরম পরাজয়। কেন আত্মহত্যার পথ মানুষ বেছে নেয় সেটা বোধগম্য নয়। আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে মানুষ হেরে যায়। কার ওপর কেন অভিমান করে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে মানুষ বিদায় নেবে কেন। নিজেকে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করে সংকট মোকাবিলা করার মধ্যদিয়ে সংকট জয় করতে হবে। সমাজে যুগ যুগ ধরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে আসছে। তবে বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার বৈশিষ্ট অনেকটা ভিন্ন। গবেষকরা বলেছেন, এখন আত্মহত্যার প্রবণতা ও বাস্তবায়ন বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা বাড়ছে। মানুষ পরিবার থেকে ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একাকীত্ব থাকতে থাকতে তার মধ্যে সহনশীল মনোভাবে সংকট তৈরি হয়। সে কারণে সে সীমিত সংকটকে বড় করে দেখে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যদি বিচ্ছিন্ন ও একা বোধ করে, তাহলে করণীয় কী, তা নিয়ে যথাযথ গবেষণা দরকার। আত্মহত্যা প্রবণতা কিসে কমবে, সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। বিষন্নতা নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার বলে মনে করেন মানসিক চিকিৎসকরা। পরিবার ও সমাজের নানা চাপের মধ্যদিয়ে আমাদের জীবন চালিয়ে যেতে হয়। ঠিক কোনো কারণে ব্যক্তি হতাশা বোধ করছে এবং সেই হতাশা কখন বিষন্নতার রূপ নিচ্ছে, সেটা ব্যক্তি ও তার আশপাশের মানুষকে বুঝতে হবে। সেই বোঝার কাজটা সহজ করতে পারে সচেতনতা কার্যক্রম। অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে বিষন্নতা প্রতিরোধ করতে পারলে আত্মহত্যা কমবে। সমাজে অস্থিরতার প্রভাব ব্যক্তির ওপর পড়ে উল্লেখ করে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা নিজেদের প্রয়োজনে একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ভেঙে একক পরিবারে নিয়ে এসেছি। এককভাবে দৈনন্দিন জীবন সামলানোর চাপ বেড়েছে। পরিবারের মধ্যে একসঙ্গে কীভাবে বাঁচতে হয়, কোথায় ছাড় দিতে হয়, সেসব ছোট থেকে শিখতে পারছে না সদস্যরা। আবার সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বোধ কাজ করছে। তারা আরও বলেন, যখন সবকিছু নিজের মতো হচ্ছে না, তখন সে হতাশ হচ্ছে; সেটা বিষন্নতা পর্যায়ে গেলে একা একা সামলে উঠতে পারছে না। এখন যেটা করতে হবে তা হচ্ছে সমাজ অনুযায়ী সমাধান নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এক সমাজের সমাধান অন্য সমাজে কার্যকর না-ও হতে পারে। পরিবারের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার ভূমিকা প্রধান। সারাক্ষণ সন্তান যেভাবে চাইবে, সেভাবে হাজির না করে তাদের নানা সমস্যা ও জটিলতা সামলাতে শেখাতে হবে। অভিভাবক যেভাবে জীবনাচরণ করবেন, যে আদর্শ মেনে চলবেন, সন্তান সেটা ফলো করে। শিশুকে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা দিতে হবে। খারাপ লাগা তৈরি হলে কার সঙ্গে শেয়ার করবে, সেটা দেখিয়ে দিতে হবে। এগুলো তার দক্ষতা। এই দক্ষতায় দক্ষ করে তুললে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। এদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কেন না, আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজে ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। ইসলামি দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা একটি জঘন্যতম মহাপাপ। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জন্ম দেন এবং একমাত্র তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করে ফেলে। এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ, কবিরাহ গোনাহ। যার একমাত্র শাস্তি জাহান্নাম। মহান আল্লাহ এমন কাজকে মোটেই পছন্দ করেন না। যদিও শরিয়তের নির্দেশনায় অনাড়ম্বরভাবে আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়ার বিধান রয়েছে, তবু রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কখনো আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়াননি। সাহাবিদের দ্বারা তা পড়িয়েছেন। নবীজি (সা.) আত্মহত্যাকারীর জানাজা আদায় না করা থেকেই অনুমান করা যায় যে, আত্মহত্যা কত বড় পাপ। আত্মহত্যা ইহকাল-পরকাল উভয়টিই ধ্বংস করে দেয়। মানুষ তার জীবনের মালিক নয়; এর প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। অতএব, আল্লাহর মালিকানাধীন জীবনের ওপর বান্দার হস্তক্ষেপ করার কোনোই অধিকার নেই। পার্থিব জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবন আমার জন্য কল্যাণকর, ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখো। আর আমাকে মৃত্যু দাও তখনই, যখন আমার জন্য মৃত্যুটা কল্যাণকর।’ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর এই প্রার্থনা থেকে আমরা যে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি তা হলো, জীবনের ভালো-মন্দের মালিক আল্লাহকেই বোঝায়, নিজ থেকে জীবনের ওপর এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া, যা দ্বারা জীবনের মহাক্ষতি হয়। জীবন একমাত্র আল্লাহর অনুদান। প্রকৃত জীবন হলো পরকালের জীবন। এই পার্থিব জীবন শুধু পরকালের প্রস্তুতিমূলক কর্ম সম্পাদনের জন্য। তাই এই জীবনের মূল্যায়ন পরকালে প্রতিদান প্রাপ্তির সহায়ক বলে গণ্য হবে। অতএব, পরিপূর্ণ ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে জীবনকে পরম সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই মহান প্রভুর অনুমতি ও নির্দেশনা ছাড়া এতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা বৈধ হবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত