ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাট ও বায়োটেকনোলজি

রত্না খাতুন ও মোঃ আতাউর রহমান
পাট ও বায়োটেকনোলজি

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাট এবং পাট শিল্পের সাথে জড়িত। জাতীয় রপ্তানি আয়ে পাট খাতের অবস্থান দ্বিতীয় এবং জিডিপির শতকরা হার ২.৮০। পাট হলো একটি প্রাকৃতিক আঁশ, যার পরিবেশগত অনেক সুবিধা আছে। পরিবেশ বান্ধব পাটের চাহিদা উত্থাপিত হয় সিন্থেটিক ফাইবারের পরিবর্তে। পাট সবজি, জিও-টেক্সটাইল, বায়োগ্যাস, বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার প্রভাব রয়েছে পরিবেশের ওপর।

মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে পাটের ঐতিহ্যগত ব্যবহার আছে। পাটের ভোজ্য প্রজাতির পাতা প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ। পাটের মূল হলো ফাইটোমেডিসিনের একটি শক্তিশালী উৎস, যা কার্যকরভাবে কিছু নির্দিষ্ট রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রদাহ এবং পাইরেক্সিয়ার চিকিৎসায় কাজ করে। মাইক্রো এবং ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট ছাড়াও এতে বিস্তৃত বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ আছে, যেমন- গ্লাইকোসাইড, ফেনোলিক্স, ফ্ল্যাভোনয়েড, ট্যানিন, স্যাপোনিন, স্টেরল, ট্রাইটারপেনয়েডস, পোর্ট হাইড্রোম এবং এফএএসি। এই পদার্থগুলোতে শক্তিশালী অ্যান্টিপাইরাটিক, মূত্রবর্ধক, ব্যথানাশক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিফাঙ্গাল, গ্যাস্ট্রোপ্রোটেকটিভ, অ্যান্টিনোসাইসেপটিভ, অ্যানালজেসিক, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিটিউমারের ক্রিয়াকলাপের বৈশিষ্ট্য আছে। তাছাড়া এ পদার্থগুলো আলফা-গ্লুকোসিডেস এবং আলফা-অ্যামাইলেজ ক্রিয়াকলাপকে বাধা দেয় এবং লিভারে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস ও বিটা-অক্সিডেশন বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পাটের বীজে পাওয়া বিরল প্রজাতির এন্ডোফাইট ব্যাকটেরিয়ার (স্টাফাইলোকক্কাস হোমিনিস) জিনোম সিকোয়েন্সিং করে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছেন। গবেষণা অনুসারে, ওই ব্যাকটেরিয়া থেকে কমপক্ষে পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ অভিনব অ্যান্টিবায়োটিককে হোমিকরসিন নামে নামকরণ করেছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে।

খাদ্যপুষ্টির ঘাটতির কারণে চোখের সমস্যা হতে পারে। গবেষণা দেখা যায়, ভিটামিন বি৬, ফোলেট এবং অন্যান্য ভিটামিন চোখের সমস্যা এবং অন্ধত্ব প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। পাট পাতায় ০.৪৯৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি৬ থাকে। পাট পাতা ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ।

এই ভিটামিন রক্ত জমাট বাঁধতে উপকারী। এটি জন্ডিস এবং পুষ্টির দুর্বল শোষণের সম্ভাবনা কমাতেও সাহায্য করে। পাট পাতা খেলে কোলাইটিস, ক্রোনস রোগসমুহ এবং স্প্রুসহ অন্য সাধারণ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। পাটের একটি জলীয় নির্যাস ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের (প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম) বিরুদ্ধে ও মশার আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী প্রতিরোধ প্রদর্শন করে।

দেহে আয়রনের ঘাটতির কারণে অস্থির লেগ সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে। এইজন্য ডাক্তার প্রায়ই এই সিন্ড্রোম নিরাময়ের জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্টের পরামর্শ দেন। বিকল্পভাবে, পাট গাছের পাতা নিয়মিত খাওয়া বাড়ালে দেহে আয়রনের ঘাটতির পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ পাট গাছের পাতায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন (২.৭৩ মিলিগ্রাম) রয়েছে। দেহে আয়রন গ্রহণ বৃদ্ধি পেশীর খিঁচুনিও কমিয়ে দেয়। পাট পাতায় রযছে ভিটামিন-সি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

এটি ভাইরাস এবং সর্দি-কাশির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের ক্ষমতা উন্নত করে। ভিটামিন-সি ফুসফুসের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়াসহ জটিলতার ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে। ক্যানসার প্রতিরোধে পাট শাক কার্যকরী। পাট পাতায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকার কারণে শরীরকে টক্সিন মুক্ত করে, ফলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। পাট পাতায় ভিটামিন বি৯ (৯০ মাইক্রোগ্রাম) রয়েছে যার ফলশ্রুতিতে ক্যানসার (সার্ভিকাল ক্যানসার, কোলন এবং ফুসফুসের ক্যানসার) হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। অনিদ্রা দূর করতে পাট শাকের ভূমিকা অনেক।

পাট শাকের মধ্যে প্রচুর মাত্রায় ম্যাগনেশিয়াম থাকায় শরীরে দরকারি হরমোন জোগান দিতে সাহায্য করে। ফলে দেহের স্নায়ুতন্ত্র সচল, শান্ত রাখে এবং অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে। পাট শাকে পর্যাপ্ত মাত্রায় ভিটামিন-ই আছে, যা শরীরের গেঁটেবাত, জ্বালাযন্ত্রণা এবং আর্থরাইটিস জনিত সমস্যার সমাধানে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাটের পুষ্টির মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এবং ফোলেটের জন্য মূল্যবান উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়তি শিশুর পথ্য হিসেবে পাট শাক খাদ্য তালিকায় রাখা যায়। পাট শাকে বেশি পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম আছে, যা শিশুর শ্রীবৃদ্ধির জন্য একটি লাভদায়ক খাদ্য হিসেবে উল্ল্খ্যে।

পাট শাকের অসংখ্য বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানের উপস্থিতির কারণে এবং এদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিক্যানসার, অ্যান্টি-আলসার, অ্যান্টিডিয়া প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন রোগের বিস্তৃতিরোধের কার্যকলাপের কারণে পাটকে ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্যে, অ্যান্টিবায়োটিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রাকৃতিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, ক্যান্সার, আলসার, ডায়াবেটিস, প্রদাহ, নিউরোইনফ্লেমেশন এবং মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে পাটের ব্যবহারিকতা মূল্যায়ন করার জন্য আরো সময় উপযোগী ও জনকল্যাণধর্মী গবেষণা প্রয়োজন এবং পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন প্রয়োজন।

ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাঙ্ক্ষিত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত, বন্যা-খরা শৈত্যপ্রবাহসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, বড় আকৃতির ফল, অল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, চাহিদামতো জাত উদ্ভাবনসহ কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির ভূমিকা অপরিসীম। বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে অল্প সময়ে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যায়।

কাঙ্ক্ষিত জাতের ফসল উদ্ভাবন করা যায়। অল্প সময়ে প্রজাতির মধ্যে বিভিন্নতা আনা যায়। বড় বড় সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবন করা যায়। রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যায়। লবণাক্ততা, খরা, বন্যাসহনশীলতা জাত উদ্ভাবন করা যায়। যেকোনো ফসল বছরের যে কোনো সময়ে চাষ করা যায় এমন জাত উদ্ভাবন করা যায়। যেসব ফসল, ফল, ফুল, সবজির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় না সেসব গাছের চারা উৎপাদন করা যায়। বছরের যেকোনো সময় চারা উৎপাদন করা যায়, মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ করা যায়। উদ্ভিদ প্রজননের জন্য হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা যায়। নাইট্রোজেন সংবন্ধন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা যায়, যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে মাটিকে উর্বর করে।

বংলাদেশে গত কয়েক দশকে আধুনিক সংকরায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে নানা ধরনের উচ্চফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং অন্যান্য আকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের হাইব্রিড ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। বেগুন চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২৯তম দেশ হিসেবে জিএম শস্য উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। মানবদেহের ওপর বিটি শস্যসমূহের ক্ষতিকারক কোনো প্রভাব বৈজ্ঞানিক গবেষণায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে টমেটো ও তুলার নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ চলছে। সফলতা পাওয়া গেছে।

ভেড়ার খাদ্যে সালফার বেশি থাকলে লোম উন্নত মানের হয়। সুর্যমুখীর সালফার এমাইনো এসিড সৃষ্টিকারী জিন ব্যকটেরিয়ার প্লাজমিড ডিএনএ’র মাধ্যমে ক্লোভার ঘাসে স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই ঘাস ভেড়া খেলেই সালফার খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। জোনাকি পোকার আলো সৃষ্টিকারী জিন তামাক গাছে স্থানান্তর করায় অন্ধকারে তামাক গাছ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। বায়বীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া হতে নিফ জিন ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাকটেরিয়া বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে মাটিতে যোগ করবে। ফলে নাইট্রোজেন জাতীয় কোন সার জমিতে দিতে হবে না। পশু পাখির রোগপ্রতিরোধের জন্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে টিকা তৈরি করা হয়েছে। যে রোগ যে জীবানু দ্বারা সংক্রমিত হয় সেই রোগের টিকা সেই জীবানু দিয়ে তৈরি হয়। ধানের কান্ড ছিদ্রকারী পোকা, পামরি পোকা ও বাদামী গাছ ফরিং প্রতিরোধের জন্য ব্যাসিলাস টক্সিন জিন ধানে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাদামি গাছ ফড়িং প্রতিরোধী ধানের জাতে ব্যাসিলাস ব্যাক্টেরিয়ার জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। ধানের টুংরো রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে কোট প্রোটিন ঢুকিয়ে। ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ডিএনএ এর পরিবর্তনের মাধ্যমে। ধানের পাতা ঝলসানো রোগ প্রতিরোধের জন্য ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। মসুর ডালের ছত্রাক রোগ প্রতিরোধের জন্য চিটিন্যাজ ও গ্লুক্যান্যাজ এনজাইমের জন্য জিন প্রয়োজন। এই এনজাইম ছত্রাকের কোষ প্রাচীর নষ্ট করে মেরে ফেলে। পাটের মাকড় ও ছত্রাক প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাক্টেরিয়া ব্যাসিলাস ব্যবহার করা হয়। লবণাক্ত সহ্য ক্ষমতা ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ডিএনএ মার্কারের মাধ্যমে ক্রসবিডিং করে। এ রকম সব ফসলের কাঙ্ক্ষিত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে অল্প সময়ে পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে টিস্যু কালচার, এন্থার কালচার, জিন ট্রান্সফরমেশন, জিন এডিটিংয়ের মাধ্যমে নন ফাংশনাল জিনকে ফাংশনালকরণ, বিভিন্ন মার্কার ব্যবহার ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে পাটের ট্রান্সজেনিক ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছে।

বায়োটেক ফসল আমাদের পরিবেশের জন্য আরো টেকসই এবং উন্নত। জৈব প্রযুক্তিতে কম কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় এবং জমির কম খরচ দিয়ে অধিক ফসলের চাষ সম্ভব হয়, কৃষিক্ষেত্রগুলো জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে- যা মাটির স্বাস্থ্য এবং জল সংরক্ষণের উন্নতি করে। বায়োটেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কীটনাশক প্রয়োগকে ৭৯০ মিলিয়ন পাউন্ড কমানো সম্ভব হয়েছে। ২০০৭ সালে জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস এবং মাটির অতিরিক্ত কার্বন সিকোয়েস্টেশন থেকে সম্মিলিত বায়োটেক ফসল সম্পর্কিত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বায়ুমন্ডল থেকে ৩১.২ বিলিয়ন পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণের সমতুল্য, যা এক বছরের জন্য প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন গাড়ি অপসারণের সমান।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত