ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মনোবিজ্ঞানের আলোকে রোজার উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ

আফতাব চৌধুরী
মনোবিজ্ঞানের আলোকে রোজার উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ

রোজা ফারসি শব্দ। এর আরবি শব্দ সাউম। সাউম অর্থ বিরত থাকা শরয়ি পরিভাষায়- ‘দিনের বেলায় খানাপিনা, যৌন সম্ভোগ ইত্যাদি হতে বিরত থাকাকে সাউম বলা হয়।” যেহেতু সাউম সাধনা দিনের বেলায় সংঘটিত হয় তাই একে ফারসি ভাষায় রোজা বলা হয়। আর রোজা পরিভাষাটিই আমাদের দেশ বহুল প্রচলিত। আবার যে মাসে রোজা রাখা হয় সে আরবি মাসের নাম রমজান। রমজান শব্দটি আসলে রমজ ধাতু থেকে এসেছে। রমজ শব্দের অর্থ হল পুড়িয়ে ফেলা। আল্লাহ মানব দেহের কাঠামো সৃষ্টি করে তার ভেতর যে আত্মা অন্তর্নিহিত করেছেন তাতে দুটি শক্তির প্রভাব রাখার ক্ষমতা দিয়েছে। এক হলো আল্লাহর নিজের শক্তি আর অপরটি হল মানুষের চিরশত্রু শয়তানের প্রভাব। মানব দেহটিকে যদি একটি মোটর গাড়ির সাথে তুলনা করি তাহলে বলা যায়, গাড়ির ড্রাইভার যেমন গাড়ির পরিচালক তেমনি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও মানুষের পরিচালক। এখন প্রশ্ন আসে ইচ্ছাশক্তির পরিচালক কে? মানব আত্মার উপর শয়তান আর আল্লাহর প্রভাব থাকাতে দু’জনই ইচ্ছাশক্তির পরিচালক। যে মানব আত্মার ওপর আল্লাহর শক্তি বেশি সে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয় অর্থাৎ তার দ্বারা সব সময় কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী কাজ হয় আর যে মানব আত্মার উপর শয়তানের শক্তি বেশি সে শয়তানের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয় অর্থাৎ সে সব সময় কুরআন সুন্নাহ বহির্ভূত কাজ করে। মানব আত্মায় শয়তানের আবাসভূমি হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য- এ ছয়টি ষড়রিপু আর আল্লাহর আবাসভূমি হলো বিবেক, যা ভালোমন্দ নির্ধারণ করে।

যে মানুষের আত্মায় ষড়রিপুর শক্তি বেশি হয়, সে মানুষ শয়তানের চরিত্র ধারণা করে আর সে মানুষের আত্মায় বিবেকের শক্তি বেশি হয়, সে মানুষ আল্লাহর চরিত্র ধারণ করে। কীভাবে মানব আত্মায় ষড়রিপুর শক্তিকে দুর্বল আর বিবেকের শক্তিকে শক্তিশালী করা যায় তা আলোচ্য বিষয়। আল্লাহ মুসলমানদের ওপর রোজা ফরজ করার একমাত্র কারণ হলো মুসলমানদের আত্মায় যাতে ষড়রিপুর শক্তি দুর্বল এবং আল্লাহর শক্তি শক্তিশালী হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি হাসিল করতে পার।’ এ আয়াতে বুঝা গেল পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যত নবী-রসুল এসেছেন সবার উম্মতের উপর ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় রোজা ফরজ ছিল। শুধুমাত্র মানব আত্মায় আল্লাহ ভীতি বা আল্লাহর শক্তি তথা বিবেকের শক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য। রোজাদার সাহরি এবং ইফতারের মধ্যবর্তী সময়ে খানা, পিনা, স্ত্রীসহবাস, মিথ্যা কথা বলা, গিবত করা, প্রতারণা করা, ঘুষ খাওয়া, সুদ লেনদেন করা, হারাম রোজগার করা অর্থাৎ শয়তানি সব কাজ বন্ধ রেখে ষড়রিপুর শক্তিকে দুর্বল করার প্রশিক্ষণ দেয়। পুরাপুরি ৩০ দিন এবং প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে একজন মুসলমান যদি শয়তান অনুমোদিত কাজ বন্ধ রাখে এবং প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা করে আল্লাহ অনুমোদিত কাজ চর্চা করে, তাহলে মানব আত্মায় বিবেকের শক্তি এতই বৃদ্ধি পাবে যে, তার প্রভাব বাকি ১১ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। রোজাকালীন সময়ে ষড়রিপুর চর্চা বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে সাউমের সংজ্ঞায় বর্ণিত হয়েছে যে, ‘দিনের বেলায় সাউম ভঙ্গকারী হতে বিরত থাকার নাম সাউম।’ রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং এ অনুসারে মিথ্যা কার্যকলাপ পরিত্যাগ করেনি তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো গরজ নেই’ রোজার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পায়। আল্লাহর ভাষায় ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ হাসিল করল সে সফল হলো আর যে একে ধ্বংস করল সেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো।’ মানবদেহের দুইটি কাঠামো। একটি দেহের অন্যটি আত্মার। দেহের শক্তি জোগায় পৃথিবী থেকে উৎপাদিত খাদ্য আর আত্মার শক্তি জোগায় ঐশ্বরিক খাদ্য। ঐশ্বরিক খাদ্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য নামাজ, জিকির-আজকার। কুরআন পাঠ, হাদিস পাঠ, রোজা রাখা ইত্যাদি। রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ-মুসলমানদের আত্মায় বিবেকের শক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য নামাজ, কুরআন পাঠ, জাকাত দান ও পুণ্য কাজে উদ্বুদ্ধ করতে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে সালমান ফারসি (রাহঃ) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে নফল ইবাদত আদায় করবেন তিনি অন্য মাসের ফরজ আদায় করার সমতুল্য সওয়াব পাবেন এবং যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি ফরজ আদায় করবেন তিনি অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবেন’ এছাড়া অন্য মাসের নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বলবৎ রেখে অতিরিক্ত ২০ রাকাত তারাবির নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ, বেশি বেশি নফল ইবাদতের আয়োজন করেছেন। যে মুসলমান কুরআন-হাদিসের বিধি অনুসারে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ৩০ দিন রোজা পালন করতে তার আত্মায় ষড়রিপুর শক্তি শূন্য হয়ে যাবে অর্থাৎ সে হয়ে যাবে নিষ্পাপ নবজাতক মানবশিশুর মতো। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যারা রমজান মাসের চাঁদের প্রথম তারিখ হতে শেষ তারিখ পর্যন্ত রোজা রেখেছে, তারা ওই দিনকার মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে।’

কিন্তু যারা সব রোজা রাখল, নামাজ পড়ল এবং কুরআন পাঠের মাধ্যমে রমজান মাস অতিবাহিত করল কিন্তু মিথ্যা কথা, গিবত করা, ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করার মত পাপ কাজ ছাড়তে পারল না, তাহলে বুঝতে হবে তার সমস্ত ত্যাগ শরিয়ত সম্মত হয়নি বলে আল্লাহর কবুল অযোগ্য হলো। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম যথার্থই বলেছেন, অনেক সিয়াম সাধনাকারী এমনি পাওয়া যাবে, যার সাউম পালনে তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া অন্য কিছু নেই।

আর এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছে, যারা রাত জেগে ইবাদত করে কিন্তু তাদের জীবনের অনিদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।’ আল্লাহর বান্দাদের পালনীয় সমস্ত ইবাদত লৌকিক। কিন্তু রোজা একমাত্র ইবাদত যা শুধুমাত্র লৌকিকতা বিবর্জিত। একজন রোজাদার রোজা পারকালে খানাপিনা বিরত করেছে কি না, তা একমাত্র সে এবং আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কেহ জানার নহে। শুধুমাত্র রোজাদারের অন্তরের আল্লাহ ভীতি তাকে খানাপিনা, যৌন সম্ভোগ মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে। না হয় পুকুরে গোসল করার সময় পানি পান করলে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাকে কেউ দেখে না। তবুও সে আল্লাহ তাকে দেখছে এ ভয়ে কখনো পানি পান করে না। সারাদিন খানাপিনা থেকে বিরত থেকে পিপাষার্ত ও তৃষ্ণার্ত হলেও ইফতারের আগে রোজাদারের সামনে রকমারি খাবারের আয়োজন হলেও নির্ধারিত সময়ের এক সেকেন্ড আগেও খাবার খাওয়া আরম্ভ করে না। রোজাদারকে কোনো পাহারাদার তো আর পাহারা দেয় না তবুও সে আল্লাহর বিধান মান্য করে। এভাবে আল্লাহ মুসলমানদের রমজান মাসব্যাপী সৈন্যবাহিনীর মতো নির্ধারিত বিধিমালায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তারা বাকি ১১ মাস আল্লাহর দেয়া বিধিমোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে পারে। সৈন্যরা যেমনিভাবে বিউগলের আওয়াজ শুনেই তাদের দৈনন্দিন কাজ আরম্ভ করে দেয় তেমনি রোজাদারগণও গভীর রাতে সাহরির জন্য সাইরেন বেজে উঠলে ঘুম থেকে উঠে রোজা রাখার জন্য সাহরি খাই। আবার সাইরেন শুনেই ইফতার করেন। তাই তো বলা হয় রোজার মাস প্রশিক্ষণের মাস। নিজেকে যেমনি দিনব্যাপী উপবাস, নামাজ, কুরআন পাঠে নিয়োজিত রাখতে হয় তেমনি যৌন সম্ভোগ, মিথ্যাচার, অসৎ ও অবৈধ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হয়। আল্লাহ মুসলমানদের ওপর কঠোর সংযম আর কৃচ্ছ্রতা সাধনসাপেক্ষ রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য মূলতঃ রমজান মাস ব্যতীত বাকি ১১ মাস ষড়রিপু শয়তানের কাজে লিপ্ত থেকে যে অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে এবং বিবেক আল্লাহর কাজ থেকে বিরত থেকে যে শক্তি হারায়, তা এ রমজান মাস কঠোর সাধনার মাধ্যমে ষড়রিপুর অতিরিক্ত শক্তিকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়; যাতে বাকি ১১ মাস শক্তি বাড়তে থাকলেও বিবেকের শক্তির অধিক না হয় অর্থাৎ বিবেক সারা বৎসর শক্তিশালী থাকে। আর বিবেকের শক্তিকে এমনভাবে বৃদ্ধি করা হয়, যাতে ষড়রিপুর শক্তির কাছে বিবেক কখনো পরাজিত না হয়। পরিশেষে বলতে হয়, সে মুসলমানের আত্মায় বিবেকের শক্তি সব সময় সময় বেশি থাকবে সে অবশ্যই আল্লাহর চরিত্রে গুনান্বিত হবে এবং তার দ্বারা কখনো ইসলামী আইনের পরিপন্থি কাজ করা হবে না এবং পরকালে অবশ্যই জান্নাতের বাসিন্দা হবে। আল্লাহ সব মুসলমান ভাইবোনদের আত্মায় বিবেকের শক্তি বৃদ্ধি করার মতো শরিয়ত সম্মতভাবে রমজান মাস অতিবাহিত করার তৌফিক দিক। আমিন। সাংবাদিক-কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত