ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন

নারীর উচ্চ শিক্ষা অর্জনে মারাত্মক প্রতিবন্ধক
পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন

পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিক্ষক ও সহপাঠীদের হাতে যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে। একটা মেয়েকে দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে পাঠানোর পর পিতামাতার ঘুম যদি হারাম হয়ে যায়, তাহলে সেই শিক্ষা মূল্যহীন হয়ে যায়। সন্তানের সম্ভ্রম কীভাবে রক্ষা পেতে পারে কিংবা সন্তানের সম্ভ্রম নিরাপদ থাকবে কি না, সেই আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অভিভাবকরা যদি প্রতিটি দিন অতিবাহিত করতে থাকেন। তাহলে অভিভাবকরাও মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে যৌন নিপীড়করা কার্যত : প্রভাবশালী। যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ ভাগই নানা ভয়ের কারণে অভিযোগ করেন না। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর তাই সুইসাড নোটে স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দিনের পর দিন। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে বরখাস্ত এবং ছাত্র সিদ্দিক আম্মানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এরই মধ্যে তাদের আটকও করা হয়েছে। শনিবারের ওই ঘটনার বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ হয়েছে। তার সহপাঠীরাও অভিযোগ করেছেন, যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের বিচার না পাওয়াই তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছে। অপরাধীদের বিচারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যাল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন অবন্তিকার সহপাঠীরা। একজন শিক্ষক কোনো ছাত্রীকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় তাকে ফেল করানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করে কোনো বিচার না পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৗন হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণায় দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে ৯ শতাংশই শিক্ষক। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্রীর ওপর ২০২২ সালের অক্টোর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ওই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গবেষণায় অংশ নেওয়াদের দেওয়া তথ্য মতে, ৫৬ শতাংশ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়।

১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ওপর এর বাইরে আলাদা কোনো জরিপ না থাকলেও ২০২১ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয় জনসমাগমস্থলে ৮১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ। ২০২২ সালে ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট’র এক জরিপে বলা হয় বাংলাদেশে অবিবাহিত মেয়েদের প্রতি তিনজনে একজন ১২ মাসে কমপক্ষে একবার যৌন হয়রানির শিকার হন। গত বৃহস্পতিবার যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে বরখাস্ত এবং বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক ছাত্রীকে অনুপস্থিত দেখিয়ে পরীক্ষায় জরিমানা আদায়, নম্বর কম দেওয়া ও থিসিস পেপার আটকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহার বিরুদ্ধে। আর বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ওই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয় ১২ ফেব্রুয়ারি। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও দীর্ঘদিন ধরে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তার বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে ২০টির মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী। ওই ছাত্রীর অভিযোগ, ল্যাবে একা কাজ করার সময় এবং কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন ওই শিক্ষক। ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। এগুলো চলতি বছরের ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায়ই কর্তৃপক্ষ প্রথমে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে তারা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রোক্টর ও ছাত্রের বিরুদ্ধে আগে একাধিককার অভিযোগ করেও ফল পাননি আত্মহননকারী ছাত্রী। তিনি আত্মহত্যার পর এখন তাদের বরখাস্ত করা হলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কোনো অভিযোগ পেলে সয়ংক্রিয়ভাবে সেলের কাজ করার কথা। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখনো যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল নেই। যারা প্রক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তাদেন জেন্ডার বুঝতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজের মতামত হচ্ছে : ‘প্রথমত যখন কোনো ঘটনা ঘটে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি হলো এটা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নেওয়া। এর কোনোটিই আমরা দেখি না।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তারা রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত। আর যারা এই ধরনের কাজ করে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে এরা রেহাই পেয়ে যায়।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের এই যদি নৈতিক মান হয় তাহলে আমরা কী শিক্ষা দেব।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত