স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স) ভাষণ দিয়েছিলেন। তার সেই ভাষণে বাঙালিদের মধ্যে কঠিন এক ঐক্য গড়ে ওঠে। তিনি স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিলেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন- ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মাতৃভূমিকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার আহ্বান জানান।

তার এ ঘোষণার মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালিদের কাছে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের- যার নাম বাংলাদেশ। বাংলার আকাশে ওড়ে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। মরণপণ লড়াই এবং একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় এ বিজয়। অপারেশন সার্চলাইট ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা। এর মাধ্যমে তারা ১৯৭১ সালের মার্চ এবং এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল, ২৬ মার্চের মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেওয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করে, অনেক স্থানে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়। এমতাবস্থায় বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। অনেক স্থানেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করেই বাঙালিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী বাঙালি জাতির এক জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল আমাদের রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের যুদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও বৈষম্যমূলক একটি স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাওয়ার পর আপামর বাঙালি পশ্চিমা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ভারতের অবিস্মরণীয় সমর্থনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এক অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। এ দিনটি বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এ দিনে বিশ্বের মাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এ দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস বেশ বর্ণাঢ্যভাবে উদযাপন করা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে দিবসের শুভ সূচনা করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক জাতীয় পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়। জাতীয় স্টেডিয়ামে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ, কুচকাওয়াজ ও শরীরচর্চা প্রদর্শন করা হয়। জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল, বেতার এবং সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে পাকিস্তানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।

পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে তারা ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনসহ ধারাবাহিক কয়েকটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে এসে উপনীত হয়। বাঙালির এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের এক পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ- আমার বাংলাদেশ, উন্নয়নের বাংলাদেশ। এ দেশকে আমরা ভালোবেসে যাব, দেশের উন্নয়নে যেন কোনো আঘাত না আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখব। মহান স্বাধীনতা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ও দৃপ্ত শপথ।