কারিগরি শিক্ষায় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান

প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ অধ্যক্ষ

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ জনবহুল ছোট্ট ভূখণ্ডের দেশ। যেখানে বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটার ১ হাজার ৩৪২ জন লোক বসবাস করে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর এবং ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর জীবনযাপন করতেন। ক্ষুধা-দারিদ্রতার কষাঘাতে জনগণ ছিল মঙ্গা নিষ্পেষিত। দেশের কোনো কোনো জায়গা ছিল মঙ্গাকবলিত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ দেশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। কৃষিকাজে বেশি জায়গায় অল্প লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় কিন্তু শিল্পে অল্প জায়গায় বেশি লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। শিল্প ছাড়া বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া যায় না। বেকারত্ব অর্থনীতিকে পিছনে টেনে ধরে এবং বিভিন্ন সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যেমন- খুন, ধর্ষণ, রাহাজানী, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, মাদকাসক্তি, ইত্যাদি।

যেটা অর্থনীতিকে আরো ভঙ্গুর করে তোলে। যদি দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যায়, তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগুতে থাকে। শিল্পের উপযোগী লোকবল অর্থ্যাৎ দক্ষ জনবল শিল্পের জন্য অপরিহার্য। দক্ষতা না থাকলে সেই জনবল শিল্পের জন্য উপযোগী হয় না। শিল্প গড়ে উঠলে দক্ষ জনবল না থাকলে দেশের বাহির থেকে লোক এসে কাজ করবে কিন্তু দেশের লোক বেকার থাকবে। এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ছিল। তাই শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করে জীবন বাজি রেখে দেশ প্রেমের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, স্বাধীনতার অন্যতম মহান স্থপতি, অকুতোভয়, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধস্ত দেশকে পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। সুখী সমৃদ্ধ দেশ গঠনে শিক্ষা অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। তাই তিনি শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দেন বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার প্রতি, যেটার প্রমাণ মিলে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানে।

সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ- ‘খ’ উপনুচ্ছেদে বলা আছে-‘সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র কর্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।‘

দেশের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় ১৯৭২ সালে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. কুদরত-ই-খুদা। ১৯৭৪ সালে এ কমিশন ৩৬ অধ্যায় বিশিষ্ট ৪৩০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। ৫ জুন, ১৯৭৪ সালে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি বঙ্গবন্ধুর কাছে হস্তান্তর করেন কমিশন চেয়ারম্যান ড. কুদরত-ই-খুদা। চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শিক্ষার অগ্রাধিকারের বিষয়টি পুনঃব্যক্ত করে বলেছিলেন- ‘বৃত্তিমূলক শিক্ষা সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে’। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য দেশের সব গণমাধ্যম, টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচারিত হয়।

উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, শিক্ষায় এই অগ্রাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিষয়ক ১৭ অনুচ্ছেদের সাথেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোড় তাগিদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম কর, নাহলে বাঁচতে পারবে না। শুধু বিএ, এমএ পাশ করে লাভ নেই আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ও কলেজ, যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানি পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে গেছে দেশটা’ বঙ্গবন্ধুর সকল অভিভাষণ, বক্তৃতামালা, প্রণীত নীতিমালাসমূহের মধ্যে উপরের বক্তব্যটি তার শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৭৪ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে বলেন ‘শিক্ষা যদি চাবি হয়, তবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হবে প্রধান চাবি’। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিকে ২০০৪ সালে ইউনোস্কো শিক্ষার অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করে। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের শিক্ষা দর্শন ছিল কারিগরি ও ভোকেশনালকে ঘিরে। ১৯৫৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে দুটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার প্রচেষ্টায় সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তান পলিটেনিক ইনস্টিটিউট (বর্তমান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে প্রথম বছর ডিপ্লোমা-ইন-প্রকৌশলী কোর্সে প্রথম ব্যাচ ভর্তি হয়।

এমনকি ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচারে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ১৩ টি বিষয় নিয়ে কথা বলেন তাঁর মধ্যে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন- ‘দ্রুত মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ স্বাধীনতার পূর্বে/পরে বেশ সময়কাল এ দেশে কৃষিতে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি ছিল না। যার ফলশ্রুতিতে খাদ্য আমদানী নির্ভর ছিল এ দেশ। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা অত্যন্ত মূল্যবান কথা এভাবে বলেছিলেন-‘পেটে ক্ষুধা রেখে ভাল চিন্তা করা যায় না’। তিনি আরও প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘ভিক্ষা করে এনে একটা জাতিকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব’। তাই তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে, ‘দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা চলবে না। জমির সুষ্ঠু উৎপাদনমুখী ব্যবহারের জন্য কৃষির প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্প্রসারণ প্রয়োজন’। বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কৃষি ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সকল ক্ষেত্রে শিক্ষা দর্শন ছিল কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে কেন্দ্র করে।

১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন সেখানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন- ‘বিশ্বের সকল সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের দ্বারা এমন কল্যাণের দ্বার খুলে দেওয়া যাবে, যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন- ‘আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে, যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম’। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সুখী-সমৃদ্ধশালী উন্নত বাংলাদেশ গড়ার। সেই ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন যে সঠিক ছিল, তা উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই কারিগরি শিক্ষার হার ও গুণগত কারিগরি শিক্ষা প্রদানের সাথে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এর একটা যোগসূত্র আছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান যাচাই করলে বিষয়টা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন কারিগরি শিক্ষার এনরোলমেন্ট জার্মানি ৮৫%, সিঙ্গাপুর ৬৫ %, অষ্ট্রেলিয়া ৭০%, জাপান ৬২%, চীন ৫৫%, দক্ষিণ কোরিয়া ৭০% অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের সকল দেশে কারিগরি শিক্ষার এনরোলমেন্ট ৫০% এর ঊর্ধ্বে। সেই লক্ষ্য অর্জনেই কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের দুঃখজনক পটভূমি সকল স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে নতুবা এতদিনে আমরা উন্নত বিশ্বে অবস্থান করতাম। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অনেক বার উদ্যোগ গ্রহণ করার পরেও আলোর মুখ দেখেনি। অবশেষে ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের আলোকে কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মান উন্নয়নে ব্যাপক ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দুটি বিভাগে বিভক্ত করেন, এর মধ্যে একটা হলো কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বর্তমান। সরকার কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য বরাদ্দও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

২০০৯ সালে বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ১ শতাংশর এর কম যা বর্তমানে (২০২২ সালে) ১৮.১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের শিক্ষা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। কারণ কারিগরি শিক্ষা হলো হাতে কলমে শিক্ষা। ২০২০ সাল নাগাদ কারিগরি শিক্ষায় ২০ শতাংশ ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ডিপ্লোমা কোর্সে আসন সংখ্যা ২০১৫ সালে ১২, ৫০০ হতে ৫৭, ৭৮০ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভর্তির ক্ষেত্রে মহিলা কোটা ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনায় নারী শিক্ষা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম এ চারটি মহিলা পলিটেকনিক বিদ্যমান। সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে আরো চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা সব মিলিয়ে হবে আটটি। আরো ২৩ জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার কাজ চলমান রয়েছে এবং সার্ভে ইনস্টিটিউট রয়েছে দুটি। এই দুটির উন্নয়ন ও আরো দুটি (পটুয়াখালীর দশমিনা ও যশোরের মনিরামপুর) স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ভূমি জরিপ শিক্ষার উন্নয়ন প্রকল্প কাজ চলমান রয়েছে, যার ফলে পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট এর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৮টি। বর্তমানে যার সংখ্যা ৪৯টি। বেসরকারি ক্ষেত্রে ৫১৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ প্রায় ১০ হাজার ৬৮৪টি বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ১ হাজার ৬৩০টি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ১৮ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষক কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগে চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। অবশিষ্ট চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) চালু আছে এবং প্রথম পর্যায়ে ১০০টি উপজেলায় ১০০টি টিএসসি স্থাপনের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অবশিষ্ট ৩২৯টি উপজেলায় একটি করে টিএসসি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যেটা সরকারের মেগা প্রকল্পের একটি। এই প্রকল্পটির বাজেট ২০৫২৫.৬৯ কোটি টাকা। তাছাড়া ৮টি বিভাগীয় শহরে আটি মহিলা টিএসসি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অদ্যাবধি ৪০২টি মাদ্রাসায় কারিগরি শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সকল মাদ্রাসায় ধাপে ধাপে ভোকেশনাল কোর্স চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সকল প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল কোর্স চালুর পাইলটিংয়ের লক্ষ্যে সেসিপ প্রজেক্টের আওতায় ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে দুটি করে কারিগরি শিক্ষার ভোকেশনাল ট্রেড চালু করেছে এবং ভবিষ্যতে সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুটি করে কারিগরি শিক্ষার ভোকেশনাল ট্রেড চালুর কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স অনুমোদনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে পরবর্তিতে অনুমোদনকৃত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে বিভিন্ন কারিগরি কোর্স চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকার যুবক থাকা সত্ত্বেও বড় সংখ্যক বাহিরের কর্মী এ দেশে কাজ করে। যারা প্রায় ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে নিয়ে যায়। কি কি দক্ষতা থাকলে আমাদের কর্মী সেই কাজগুলো করতে পারবে সরকার এ বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করছে। সরকার যে ১০০টি ইকোনোমিক জোন ও হাই-টেক পার্ক তৈরি করছেন যেখানে প্রায় ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই দক্ষ জনবল তৈরি এবং বিদেশগামী দক্ষ জনবল তৈরির জন্য টিএসসিগুলোতে শিক্ষার সাথে দক্ষতা অর্জনের জন্য HUB হিসেবে কাজ করবে। যেখানে ঝরে পড়া, পিছিয়ে পড়া ও বেকার যুবকদের (বিকালে ও ছুটির দিনগুলোতে) দক্ষতা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ সব দক্ষ জনশক্তি দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশগামী দক্ষ জনশক্তি হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। সরকার জেলা ও বিভাগীয় শহরে টিএসসিগুলোকে Common facility center (CFC) হিসেবে তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এছাড়া সরকার কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কয়েকটি টিএসসিকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারিগরি শিক্ষার প্রতি খুবই আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ হলো ৪ অক্টোবর ২০২০খ্রি. কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ১১৩টি প্রতিষ্ঠানে (৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এর অনুকুলে ১২ হাজার ৬০৭টি পদ সৃষ্টি করেছেন। কারিগরি অঙ্গনে জনবল কাঠামোতে এত পদ একবারে আর কখনো সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে সরকারের নির্দেশনায় চালুকৃত কারিগরি বিভিন্ন শিক্ষাক্রমের কোর্সকে আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে কিছু শিক্ষাক্রমের আধুনিকীকরণের কাজ শেষ হয়েছে। যেমন- বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট শিক্ষাক্রমকে বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট অ্যান্ড টেকনোলজিতে রূপান্তর করে দ্বৈত সনদায়নের ব্যবস্থা রেখে কারিগরি নির্ভর করে নতুন করে সাজানো হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম থেকে ব্যবসা ক্ষেত্রে মধ্যম স্তরের কর্মী তৈরি হবে। এ স্তরের কর্মীর বর্তমানে দেশে এবং আন্তজাতিক অঙ্গনে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া এসএসসি অঙ্গনে (ভোকেশনাল) কোর্সকে NTVQF অ্যালাইন করে দ্বৈত সনদায়নের ব্যবস্থা রেখে ১৩টি ট্রেডের শিক্ষাক্রমকে পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই- এরূপ দক্ষ জনবলকে স্বীকৃতি দানের জন্য Recognition of Prior Learning (RPL) ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এ স্বীকৃতি মাধ্যমে তারা সামাজিক মর্যাদা পাবে ও আর্থিকভাবে উপকৃত হবে। যার ফলে কারিকরি শিক্ষায় হার বৃদ্ধি পাবে। স্বীকৃতি প্রাপ্ত এসব জনবল বিদেশ গেলে বেশি Remittance পাঠাতে পারবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। সরকার ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যেসব চড়ষরপু গ্রহণ করেছে সেখানেও কারিগরি শিক্ষার হার বাড়ানোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

* National Strategy for Accelerated Poverty Reduction II (Revised) ঋণ ২০০৯-১১ তে বলা আছে-২০২০ সালের মধ্যে TVET Enrolment হতে হবে ২০%।

* National Education Policy ২০১০ এ বলা আছে-দেশী/বিদেশী চাহিদার নিরিখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, শ্রম মর্যদা বাড়ানোর জন্য, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দক্ষ ও সক্ষম জনবল তৈরী করতে হবে।

* National Skills Development Policy ২০১১ তে বলা আছে সকল সেকেন্ডারি শিক্ষার্থীদের মধ্যে TVET Enrolment হবে ২০%।

* Perspective Plan of Bangladesh ২০২১-২০৪১ বলা আছে- যারা কাজের জন্য দক্ষতা অর্জন করতে চায় তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সহজলভ্য করা। ২০৩১ সালের মধ্যে TVET Enrolment করতে হবে ৩০% এবং ২০৪১ সালে ৪১%। এই Policy তে আরো বলা আছে- IR-4.0 এর প্রস্তুতির জন্য TVET কে Mainstreaming করতে হবে।

* Integrated TVET Development Action Plan-TMED কর্তৃক করা হয়েছে। সেখানেও বলা আছে ২০৩০ সালের মধ্যে TVET Enrolment ৩০% হতে হবে। কারিগরি প্রশিক্ষণকে মান সম্পন্ন করার জন্য সরকার National Skill Develop Academy (NSDA) প্রতিষ্ঠা করেছে। এ লক্ষ্যে ঘঝউঅ বহুমুখী কার্যক্রম শুরু করেছে। সরকার কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে উপরোল্লিখিত কার্যক্রম ছাড়া নিম্নবর্ণিত প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

চলমান প্রকল্পসমূহ ঃ ক্র:নং প্রকল্পের নাম

০১. অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদ্যমান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন

০২. বাংলাদেশ ভূমি জরিপ শিক্ষার উন্নয়ন

০৩. কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সক্ষমতা বৃদ্ধি

০৪. স্কিলস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ (সেপ-বি) প্রজেক্ট

০৫. Skills 21: Empowering Citizens for Inclusive and Sustainable Growth

প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ : ক্রঃ নং প্রকল্পের নাম ০১. বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন০২. টিভিইটি সেক্টরে শিক্ষকতার গুনগত মান উন্নয়ন ০৩. কক্সবাজার টিএসসি প্রাঙ্গণে কারিগরি শিক্ষক লিডারশীপ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ০৪. নির্বাচিত বেসরকারি কারিগরি স্কুল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে আইসিটির উন্নয়ন ০৫. বেসরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ০৬. টিভিইটি সেক্টরে জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো (NTVQF) এর বাস্তবায়ন ০৭. গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের আধুনিকীকরণ ০৮. বিদ্যমান ৩২টি টিএসসিতে কম্পিউটার ও ইনফরমেশন টেকনোলজি (সিআইটি) ট্রেড অন্তর্ভুক্তকরণ এবং অবশিষ্ট বিদ্যমান ৩২টি টিএসসিতে সিআইটি ট্রেডের উন্নয়ন ০৯. টিভিইটি সেক্টরে দক্ষতা ম্যাপিং ১০. ৬৪টি জেলায় RPL সেন্টারের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করা ১১. Skills 11 Empowering Citizens for Inclusive and Sustainable Growth ১২. কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের আধুনিকীকরণ এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতকরণ ১৩. মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বেসরকারি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ ১৪. জেলা পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস স্থাপন। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ প্রায় ২৩টি মন্ত্রণালয় কারিগরি প্রশিক্ষণের বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করছে। সরকারের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বেকার সমস্যার সমাধান করে অর্থনৈতিকভাবে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে এবং সরকারের সকল রূপকল্প বাস্তবায়িত হবে এবং ২০৪১ সালের আগের বাংলাদেশ একটি উন্নত ও স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হবে। পূর্ণতা পাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।।

[লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও সূত্রে : (ইন্টারনেট, জার্নাল, রিপোর্ট, প্রতিবেদন) আলোকে উপরোক্ত লেখাটি সংকলন ও রচনা করা হয়েছে। ]