ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুপেয় পানির অধিকার হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

অলোক আচার্য
সুপেয় পানির অধিকার হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে, গোল্ডম্যান স্যাক্স নামে একটি আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ভবিষ্যতবাণী করে বলেছিল, পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ পানি সংকটে পড়বে, যার অর্ধেকই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। ওয়ার্ল্ড ভিশনের ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর ১০টি দেশ তীব্রভাবে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি বঞ্চিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই তালিকার শীর্ষে থাকা ১০টি দেশে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস।

বতর্মানে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানি আসে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এর গুরুত্ব না বোঝা, প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন করা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এই সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষকেরা বলেছেন, ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষ অন্তত এক মাস পানি সংকটে ভুগেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০ কোটিতে। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১ শতাংশ সুপেয় পানি, যার বেশির ভাগই পাওয়া যায় বরফের তলে। বাকি পানি লবণাক্ত। সুপেয় পানির মান সাধারণত ভালো হয়ে থাকে। প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর খাদ্যের পাশাপাশি যা আবশ্যকীয় তা হলো পানি। এক-দুইবেলা খাদ্য না খেয়েও দিব্বি মানুষ বেঁচে থাকছে কিন্তু পানি ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। প্রাণের উৎস পানি। একফোঁটা পানির তৃষ্ণার সময় সব খাবার অপ্রয়োজনীয়। পানি হলো একটি অজৈব, স্বাদহীন, প্রায় বর্ণহীন, গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ। তবে সেই পানি হতে হবে সুপেয়। কারণ সুপেয় পানির বাইরে যে পানি রয়েছে তা পান অযোগ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকির। পানির অস্তিত্ব খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালাচ্ছে। কারণ, পানির সন্ধান পেলেই সেখানে প্রাণের খোঁজ মেলা সম্ভব। আবার পৃথিবীর পরবর্তী মানুষের বাসস্থান এসব গ্রহ হতে পারে যদি সেখানে পানি পাওয়া যায়। আমাদের এই ভূমণ্ডলের বেশিরভাগ অংশই পানি হলেও খাওয়ার উপযোগী পানির পরিমাণ কম। সেই কম থেকে আরও কমে আসছে। নিরাপদ পানির উৎসস্থল ক্রমেই আশংকাজনকভাবে কমে আসছে। পানির জন্য রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বিভেদ, উপমহাদেশীয় আন্তঃকলহ।

২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী গোটা বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের নিরাপদ পানি সুযোগ নেই। পানির তীব্র সংকটে যারা রয়েছে এর অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। সারা বিশ্বেই এই এক চিত্র। অথচ পানির অপচয় কমাতে পারলে এবং সুষ্ঠু বণ্টন করতে পারলে এই দরিদ্র্র শ্রেণির অনেককেই পানি থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। আমাদের দেশে বৃষ্টি বা এরকম উৎস থেকে যে পানি আসছে তার অধিকাংশই নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ তা মাটিতে ফিরে যেতে পারছে না। অধিকাংশ নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পানির সংকট ঘনিভূত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র .০১৪ ভাগ খাবার পানি রয়েছে। নিরাপদ পানির জন্য বাজারের বোতলজাত পানি কিনে খাওয়া আজ একটি সাধারণ দৃশ্য। সেই বোতলজাত পানিই যে নিরাপদ তার নিশ্চয়তাও বা কিভাবে পাই! কারণ মাঝে মধ্যেই অসাধু ব্যবসায়িদের বোতলজাত পানির নামে অনিরাপদ পানি ভরে বিক্রি করার খবর পাই। এসব বাদে এটি নিরাপদ এবং পানযোগ্য। কিন্তু কতজনের এই পানি বাজার থেকে কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে? আর থাকলেও কতবার? জানা যায়, বিশ্বে মোট মজুত পানির পরিমাণ এক হাজার ট্রিলিয়ন টন। তার মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত পানির পরিমাণ ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অপরদিকে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ পানি জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফ আকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ পানি সুপেয় হলেও প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ পানি রয়েছে ভূগর্ভে, যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে পরিচিত। এই পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্যে দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে।

আমরা জেনে এসেছি এই ভূভাগের তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তিনভাগ জল হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব আজ পানি সংকটের মুখোমুখি। আরো ষ্পষ্ট ভাষায় বললে, পানযোগ্য এবং ব্যবহারযোগ্য পানির তীব্র সংকটের মুখোমুখি এই ধরণী। আমাদের দেশে কেবল রাজধানী ঢাকা শহর নয় বরং প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহরগুলোতেও শুকনো মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায় এবং নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই সমস্যা আরো তীব্র হচ্ছে। যখন বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কেবল পানির জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একত্রিত হবে, সেদিনটা হবে ভয়াবহ। কারণ একফোঁটা পানি অন্য সব খাদ্যের চেয়ে বহুগুণে মূল্যবান। পানযোগ্য পানির অপর নামই যে জীবন। মানুষ আজ তেল, গ্যাস বা এরকম প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য যুদ্ধ করছে। এমন একসময় আসতে পারে যখন পানির দখলের জন্য প্রচেষ্টা শুরু হবে। কারণ শুকনো গলায় তো আর যুদ্ধ হয় না। তাই আগে পানি তারপর সবকিছু, যা আমাদের জীবন ও জীবিকার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

সারা বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর আজ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। কয়েকটি শহর তো রীতিমত পানিশূন্য হওয়ার আশংকায় ভুগছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সতর্ক করে বলেছিলেন, পানির স্বল্পতা বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। তেল, গ্যাস নিয়ে আজ যত প্রয়োজন অনুভূত হয় তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে পানির। এবং পানযোগ্য পানির দখলে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব নয়।

২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে বিশুদ্ধ পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমণের উপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বর সুপেয় পানি সম্পর্কিত যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। ভু-গর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহার এই সংকটকে আরও ঘনিভূত করছে। পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে মাঝে মধ্যেই উত্তেজনা তৈরি হয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে প্রায় ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পরবে। এখনই বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানি পায় না অথবা তাদের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছায় না। এক গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন পান করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পায় না এবং প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার শিশু দূষিত পানি পান করে মারা যাচ্ছে। পানি ব্যবহারেও উন্নত বিশ্বের মানুষের সাথে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের ব্যবহারে পার্থক্য বিদ্যমান। ইউনিসেফ এর আগে এক জরিপে বলেছিল, আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। সুপেয় পানির সুযোগ বঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের দেশের অবস্থান সপ্তম। পানযোগ্য সুপেয় পানির চাহিদা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় আমদের বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।

এর মধ্যে মিঠা পানির উৎস সৃষ্টি করা, জেলা উপজেলা পর্যায়ে সুপেয় পানির প্ল্যান্ট করা, দেশের সর্বত্র বৃষ্টির পানির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, শহরের মতো গ্রামের মানুষের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা করা, দেশের খাল বিল ও জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে, পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে হবে, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আর পানির অপচয় রোধ করতে হবে এবং পানির পুনর্ব্যবহার করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত