রাজধানীতে মশার কবলে মন্ত্রী-মেয়র

এবার আর সত্য লুকানোর সুযোগ থাকল না

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীতে মশক নিধন করতে গিয়ে একজন মন্ত্রী ও একজন মেয়র মশার কামড় খেয়েছেন। বিষয়টি রীতি মতো দুঃখজনক। একজন মন্ত্রী ও মেয়রের পুলিশি প্রোটোকল উপেক্ষা করে মশক বাহিনী তাদের ওপর চড়াও হওয়ার খবরটি প্রথম প্রথম বিশ্বাস করার মতো ছিল না। তবে বোধগম্য হতে কিছুটা সময় লেগেছে। একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি একটু গভীরভাবে পড়ার পর ভুল ভেঙে গেল। আসলেই তারা অসহায় নাগরিকদের মতো মশার কামড় খেয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের মতো মশা তাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আমাদের দেশে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা কোনো ধরনের অভিযোগ পাত্তা দিতে চান না। কোনো কিছু হলে বিষয়টিতে রাজনৈতিক রং লাগান। যে কোনো কিছুতেই এই অভ্যাসটি তারা চর্চা করেন। রাজধানীবাসী মশক বাহিনীর কবলে পড়েছে এবং নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ঘুমাতে পারছে না। মানুষ প্রতিনিয়ত জ্বরসহ নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। এমন বাস্তবতা কর্তা বাবুরা বিশ্বাস করতে চান না। তারা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনকেও সহজেই গুরুত্ব দিতে চান না। তবে মশক বাহিনী মন্ত্রী ও মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কামড়িয়ে অভিযোগ সত্যতা প্রমাণ করেছে। রাজধানীর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে রাজউকের একটি খাল পরিষ্কার ও মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ সময় মশা নিধনে খাল (লেক) পরিষ্কার কর্মসূচি পরিদর্শনে যান, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেখানে গিয়েই তারা মশার কামড় খেয়েছেন গত বুধবার। একই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাসহ ঢাকা উত্তর সিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে মন্ত্রী, মেয়র ও অতিথিসহ উপস্থিত সবাই মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক লাইভ ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। ওই ভিডিওতে মন্ত্রী, মেয়রসহ অন্যদের হাত দিয়ে মশা তাড়াতে দেখা যায়। কেউ কেউ মশায় কামড় দেওয়া স্থানে হাত দিয়ে চুলকাচ্ছিলেন। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা। তা হলে ঘটনাটি এবার তো মিথ্যা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ পাবে না সিটি করপোরেশন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জানান, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোর সক্ষমতা পর্যালোচনা করে যতটুকু দরকার মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এডিস মশা নির্মূলে জনপ্রতিনিধি এবং জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নিজের বসতবাড়ি এবং এলাকা পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সবাই নিজের দায়িত্ব পালন করলে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু জ্বর থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব। ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিউলেক্স মশা নিধনে আমরা খাল পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু করেছি। এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও খালের কচুরিপানা থেকে প্রচুর মশা জন্মায়। স্থায়ী সমাধানের জন্য খাল পরিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। এই খাল ডিএনসিসির না হওয়া সত্ত্বেও মশা নিধনের লক্ষ্যে আমরা পরিষ্কার করছি।’ খাল পরিষ্কার করার পর সেখানে যাতে তা আবার ময়লা না জমে তা নিশ্চিত করবে কে? সেই প্রশ্নও তো থাকতে পারে। গত বছর মশার লার্ভা নিধনের জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির কারণে সেটি ব্যবহার করা যায়নি। তাই এবার আমরা সিটি করপোরেশন থেকে সরাসরি বিটিআই আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওষুধ ছিটানোর জন্য অত্যাধুনিক মেশিনও আনার প্রক্রিয়া চলছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বর্ষার আগেই প্রস্তুতি নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হচ্ছে। তবে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে কি না, তা নিয়েও তো সংশয় রয়েছে। গত বছর এডিস মশার ভয়াল আক্রমণে সর্বোচ্চসংখ্যক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫। চলতি বছরেও এডিস মশার সেই তাণ্ডবলীলা অব্যাহত রয়েছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত এবং এর ধ্বংস নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগকৃত লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইডের কার্যকারিতা, প্রয়োগ পদ্ধতি, ব্যবহৃত মেশিনের কর্মদক্ষতা, প্রয়োগকারীর প্রশিক্ষণের প্রায়গিক দক্ষতা, সর্বোপরি এডিস মশার প্রতিরোধী হয়ে ওঠার তীব্রতাণ্ডএ সবকিছুই যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর বিশেষজ্ঞদের তদারকিতে না হয়, তাহলে সময় যত গড়াবে এর ভয়াবহতা ততই বৃদ্ধি পাবে। এডিসের এ ভয়াবহতার পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে সারা রাত পর্যন্ত দাপট দেখায় কিউলেক্রা প্রজাতির মশা। এ মশা শুধু গুণ গুণ করে শুধু মানুষের নিদ্রাভঙ্গই করে না বরং ফাইলেরিয়া, ইনক্যাপালাইটিস ওয়েস্টনিল ভাইরাস ইতক্যাদির মতো মারাত্মক রোগ ছড়ায়। এ প্রজাতির মশা আমাদের দেশে অত্যাধিক। গো-মূত্র, দূষিত পানি, জমে থাকা পানি, ডোবা-নালা, শহরের পরিত্যক্ত ম্যানহোলসহ অপরিচ্ছন্ন স্থানে জমা পানি এ মশার প্রজনন উৎস। ঢাকা শহরের যেসব অপরিচ্ছন্ন লেক, নালা ও জমানো পানি রয়েছে, সে স্থানগুলোতে সন্ধ্যার সময় এ মশার আনাগোনা বাড়ে। নগরজীবনের অনেক সমস্যার মধ্যে এ মশার সমস্যাটি অন্যতম। তবে মশার উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী, তা নিয়ে রীতিমতো হয়তো গবেষণা করার দরকার হতে পারে।