ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ন্যাটো জোটের বিস্তারে দীর্ঘায়িত শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত

অলোক আচার্য
ন্যাটো জোটের বিস্তারে দীর্ঘায়িত শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত

প্রায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই ন্যাটোর সম্প্রসারণ বিষয়টি জোরেশোরে সামনে আসে এবং এর ফলে যে পুতিন অসন্তুষ্ট সেটিও সামনে আসে। কিন্তু শুরু থেকেই সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করতে থাকে। অবশেষে ২ বছর অপেক্ষার পর সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ পেল সুইডেন। গত ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সামরিক জোটে যোগদান করে দেশটি। এর মধ্যদিয়ে ন্যাটোর ৩২তম সদস্য রাষ্ট্র হলো সুইডেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যাটোর জন্য সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের যোগদান গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারণ। সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার মধ্যে ১,৩৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এখন থেকে সুইডেন ন্যাটোর কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সহায়তা পাবে। তাছাড়া সুইডেন ন্যাটো বাহিনীতে অত্যাধুনিক সাবমেরিন এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত ফাইটার জেটগুলোর একটি বড় বহর যুক্ত করবে। দেশটি আটলান্টিক এবং বাল্টিকের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লিংক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হওয়া ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনেও ঘুরেফিরেই এ বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। এর ফলে সুইডেন ন্যাটোর দেশগুলোর কাছ থেকে সুরক্ষা পাবে এবং সুইডেন কোনোভাবে আক্রান্ত হলে ন্যাটো এগিয়ে আসতে বাধ্য। ন্যাটো একটি সামরিক জোট এবং নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সামরিক জোট। আরও বহু বছর আগে থেকেই এই জোট আরো প্রসারিত করার চেষ্টাই করছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এর আগে গত বছর ফিনল্যান্ড ন্যাটোর ৩১তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর নর্ডিক দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন একসঙ্গে ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন করে। ফিনল্যান্ড যোগ দেওয়ার ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সীমান্ত প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর এবার সুইডেন যোগ দেওয়ায় নর্ডিক অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার দুশ্চিন্তা আরো বৃদ্ধি পেল। মাঝে সুইডেনের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে তুরস্কের ও হাঙ্গেরির আপত্তিতে বিষয়টি সম্ভবত দীর্ঘায়িত হলো। এর মাধ্যমে নর্ডিক দেশগুলো ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড) সবাই এই সামরিক জোটের সদস্য হলো। ফলে কৌশলগতভাবে দেশগুলোর সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হলো। গত বছর ফিনল্যান্ডের যোগদান সম্পন্ন হওয়ার পর বাল্টিক অঞ্চল থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ওপর পর্যন্ত ন্যাটো-রাশিয়া সীমানা বিস্তৃত হয়। এই দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান রাশিয়ার আক্রমণের ভয় ন্যাটোর সম্প্রসারণকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। এই বিষয়টিকে আরো এগিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন ইস্যু। এটি এখন বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে, যে ন্যাটোই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে। সামরিক জোটের পরিসর বাড়ানো যে রাশিয়াকে চিন্তিত করে তুলতে পারে তা ১৯৯৯ সালের সম্প্রসারণের উদ্যোগের আগেই আলোচিত হয়। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো গঠিত হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। এরপর পঞ্চাশের দশকে যোগ দেয় তিনটি দেশ-১৯৫২ সালে গ্রিস ও তুরস্ক এবং ১৯৫৫ সালে জার্মানি। এর দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পরে ১৯৮২ সালে স্পেন ন্যাটোর সদস্য হয়। তারপর ১৯৯৯ সালে চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্যপদ পায়। ২০০৪ সালে অনেকগুলো দেশ ন্যাটোভুক্ত হয়। এ দেশগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া। আলবেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ন্যাটোতে যোগ দেয় ২০০৯ সালে। এরপর ২০১৭ সালে মন্টিনিগ্রো এবং ২০২০ সালে নর্থ মেসিডোনিয়া ন্যাটো সদস্যপদ লাভ করে। গত বছর ফিনল্যান্ড এবং সম্প্রতি সুইডেন সদস্যপদ লাভ করে। রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি এবং ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানো বা না জড়ানো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে এখনও যুদ্ধে জড়ায়নি এবং দ্রুত সেই সম্ভাবনা নেই। তবে একেবারেই যে সম্ভাবনা নেই সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

কারণ এ নিয়ে ক্রমশই উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। কারণ প্রত্যক্ষভাবে ন্যাটোর যুদ্ধে জড়ানো অর্থ হলো- একটি ব্যাপকার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সেই ঝুঁকি এখনই নেবে না ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো। ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলেই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশকে সহজেই আক্রমণ করা সহজ কথা নয়। ইউক্রেন এখনো ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারেনি; কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে যা রাশিয়ার ইচ্ছে নয়। হয়তো ভবিষ্যতে দেশটিও ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের সম্প্রসারণ বনাম রাশিয়া। ন্যাটো গঠিত হয়েছিল, এমন একটি সময় যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধের সেই মাত্রা না থাকলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। পুতিন দাবি করেন যে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল, যে ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল, এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ন্যাটো জোটের এই সম্প্রসারণ যা রাশিয়া মেনে নিতে পারছে না। ন্যাটো যদি ইউক্রেন যুদ্ধে সৈন্য পাঠায়, তাহলে রাশিয়া তার শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে এবং সেক্ষেত্রে তা পরমাণু যুদ্ধের দিকেই ঠেলে দিতে পারে। এমন আভাস পুতিন নিজেই দিয়েছেন। ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর পশ্চিমের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের সবচেয়ে টানাপড়েন চলছে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে। এদিকে পুতিন এর আগেও ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পুতিন পশ্চিমা রাজনীতিকদের ইতিহাসে ফিরে তাকানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষ করে নাৎসি জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার এবং ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ব্যর্থ রাশিয়া আক্রমণের ইতিহাস। প্রশ্ন হলো, ন্যাটো সম্প্রসারণে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা এক সময়কার শীতল যুদ্ধের দিকেই ইঙ্গিত করে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত