ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের ব্যাকিং খাতের অস্থিতিশীলতা

সবল রাখতে হবে অর্থনীতির এই প্রাণশক্তিকে
দেশের ব্যাকিং খাতের অস্থিতিশীলতা

দেশের ব্যাকিং খাতে মূলত অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। অথচ জাতীয় অর্থনৈতিক গতি প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্য এই প্রাণশক্তিতে সবল রাখতে হবে। দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়ার কাজ শুরু হওয়ার পর ব্যাকিং খাতে অস্তিরতা বিরাজ করছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এখন রীতিমতো ভয় পাচ্ছে সবল বা ভালো ব্যাংকগুলো। শক্তিশালী অবস্থানে আছে, এমন ব্যাংকের ওপর দুর্বল কোনো ব্যাংককে চাপিয়ে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে ব্যাংকপাড়ায় চলছে নানা গুঞ্জন। চলছে আলাপ-আলোচনা। ব্যাাকিং খাত নিয়ে যাতে মানুষ সঠিক তথ্য পেতে না পারে- সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকরা আগের নিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারেননি। ওপরের নির্দেশে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এটা সুস্থ ও স্বাভাবিক কোনো অবস্থা নয়। রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে থাকা ব্যাংকের তালিকা প্রকাশ করার পর বিভিন্ন পক্ষের চাপের মুখে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণের বিষয়টি। বিশেষ করে ভালো ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার খবরে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর খারাপ ব্যাংক চাপিয়ে দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরইমধ্যে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার জন্য দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করেছে। দেশের ৫৪টি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ৩৪টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্য থেকে আগামী বছরের শুরুর দিকে ১০ ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার কথা ভাবা হচ্ছে। ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংক খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তার মধ্যে ৯টি রেড জোনে চলে গেছে। ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে ৩টি ব্যাংক আবার রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে। মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে আছে। এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। সেটি না হলে আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরইমধ্যে শরিয়াভিত্তিক এক্সিমের সঙ্গে সুদে লেনদেন করা পদ্মা ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করানোর ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একীভূত করে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে ভালো কোনো ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দুর্বল ব্যাংককে চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বক্তব্য হচ্ছে, পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো হলেও কোনো ব্যাংককে আরেকটি ব্যাংকের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। চাপ দিয়ে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে তার ফল ভালো নাও হতে পারে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকস হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮টি দেশি ও ৮টি বিদেশি ছাড়াও বাকি সব ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকটে, অর্থাৎ রেড জোনে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইয়েলো জোনে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকসহ ১৯টি বেসরকারি ব্যাংক এবং আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক আছে। নিরাপদ অবস্থানে থাকা গ্রিন জোনে আছে প্রাইম, ইস্টার্ন, হাবিব, এনসিসি, মিডল্যান্ড, ব্যাংক আলফালাহ, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, উরি, এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এই বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তথ্য-উপাত্তের অভাবে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সার্বিক বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে দেশের ব্যাকিং খাত তেমন শক্তিশালী নয়। অথচ ব্যাকিং খাত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির জন্য প্রাণশক্তি। ব্যাকিং খাত স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশের অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সে কারণে কীভাবে দেশের ব্যাকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার পর যদি তার মনের মধ্যে গচ্ছিত অর্থ নিয়ে কোনো প্রকার দুশ্চিন্তার জাগ্রত হয়, তাহলে মানুষ ব্যাংকিং চ্যানেলে আর টাকা-পয়সা জমা রাখবে না। ফলে ব্যাকিং খাত থেকে ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন না। ব্যাকিং ঋণ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো ব্যবসায়ী দেশে খুব একটা নেই। দেশে শিল্প-কলকারখানা গড়ে না উঠলে কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হবে। শিক্ষিত মানুষ বেকার হয়ে জীবনযাপন করতে গিয়ে নানা রকম অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। সে কারণে বাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত