ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আত্মহত্যায় মেয়েরা কেন এগিয়ে

সালামা ফাইয়াজ
আত্মহত্যায় মেয়েরা কেন এগিয়ে

বরিশালের বানারীপাড়ার চাখারে দরিদ্রতা ও অসুস্থতার কারণে এক মহিলার আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। ১০ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রুবিনা বেগম (৩৮) নামের এক মহিলার ভাড়া ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছে তার সহপাঠী ও শিক্ষকের নিপীড়নে। অবন্তিকাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার দায় কি আমরা এড়াতে পারি? ১৭ মার্চ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী দেবশ্রী রায় তার স্বামীর বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এদিকে বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করেছেন। এসব আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তা কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিরাজমান। প্রথম যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসুস্থতা। আমাদের সমাজে এখনও দারিদ্র্য পরিপূর্ণভাবে আমরা নির্মূল করতে পারিনি এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে পারিনি। যদি আমরা স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে পারতাম এবং দারিদ্র্য যদি কিছুটা লাঘব করতে পারতাম, তাহলে রুবিনা বেগমের আত্মহত্যা করতে হতো না; এমন করুণ দৃশ্যও আমাদের নিষ্পলকভাবে দেখতে হতো না। এ আত্মাহত্যার মূল কারণ পাওয়া গেল দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যসেবার দুষ্প্রাপ্যতা। কাজেই সমাজব্যবস্থাকে সুন্দর করতে হলে প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হবে এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা তৃণমূলে পৌঁছে দিতে হবে। জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- এ মৃত্যুটি আরো করুণ। কাঠামোগত ব্যবস্থার মধ্যে তাকে নিপীড়ন করে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এমন একটা জীবন- যার স্বপ্ন ছিল, প্রত্যাশা ছিল, তা কেমনে হারিয়ে গেল। এর দায় আমাদের সবার নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কত রঙিন স্বপ্ন আমাদের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। সেখানে আমারা আমাদের শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর খাবার, মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছি না; সেখানে শিক্ষার্থীর পাশে না দাঁড়িয়ে আমরা তাদের স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা বিশাল পরিসর আমাদের মেধা-মননশীলতার চর্চা প্রাণকেন্দ্র না হয়ে কেন স্বপ্ন ঝরে যাওয়ার কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি করছি। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি সক্রিয় থাকবে না, কেন শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে অবকাঠামোগত সুবিধা থাকবে না। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সুন্দর পরিসরে অশিক্ষকসুলভ আচরণ শিক্ষকদের মধ্যে কেন দেখা যাবে, কেনইবা শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস আমরা তৈরি করতে পারিনি। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস আমরা এখনো কেন তৈরি করতে পারিনি। আমাদের দেশে নারীরা এখন কোনো কাজে পিছিয়ে নেই; রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা, চাকরিসহ জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে সমানতালে নারীরা অংশগ্রহণ করছে; গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবুও কেন বিশ্ববিদ্যালকে আমরা সমতার মানদ-ে আনতে পারিনি। এ দায় আমাদের রাজনীতির; এ দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করত, শিক্ষক দ্বারা যদি শিক্ষার্থী নিরাপত্তা নিশ্চিত হত, ছেলে সহপাঠী দ্বারা যদি মেয়েদের নিরাপত্তা বজায় থাকত তাহলে আজ ফাইরুজ অবন্তিকার মতো একজন মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীকে নিজের প্রাণ দিতে হত না। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে, তার কারণ দেখা যাচ্ছে পারিবারিক। মেয়েটি স্বামীর সঙ্গে থাকত, অন্যদিকে এ মেয়েটিও মেধাবী। সংসারের ঘানি হয়তোবা মেয়েটির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল; ফলে মেয়েটিকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। পারিবারিক বলয়েও আমরা আমাদের নারীর মন বোঝার চেষ্টা করি না; তার ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে মাথা ঘামাই না; অপরদিকে তার স্বপ্ন ঝরে যাচ্ছে- এসব লোড নিতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করল। এখন আসি আমাদের পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর, ভাইবোন, মা-বাবার মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকার কারণেই কিংবা দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের মেয়েরা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে স্বামী হিসেবে কিংবা মা-বাবা হিসেবে আমরা কি আমাদের স্ত্রী কিংবা মেয়ের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি। পারিবারিক বলয়ে ছেলেদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, কন্যাসন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। আমাদের পারিবারিক কাঠামোয় নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত হয়নি; ফলে নারীর শ্রম, মেধা সবকিছুই অমূল্যায়িত থেকে যায়। এক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমাদের সমাজে যৌতুক ও নির্যাতনের কারণে কত নারী আত্মহত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নাই। এখন আসি সাদি মহম্মদের আত্মহত্যা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে পিতা হারানো সাদি জীবনে ক্ষমতার পেছনে ছুটেননি। সারাজীবন নান্দনিকতার চর্চা করেছেন, সংগীতভুবনে ডুবে ডুবে নিজেকে খাঁটি করেছেন। হয়তোবা জীবনের প্রত্যাশা ছিল একটু স্বীকৃতির। কিন্তু তা পাননি, ফলে অভিমান নিয়ে চলে গেলেন। নৃত্যশিল্পী ও তার পারিবারিক বন্ধু শামীম আরা নিপা প্রয়াত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদকে নিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিল্পীরা তো একটু অভিমানী হয়। অনেক কিছু নিয়েই হয়তো তারমধ্যে অভিমান ছিল, হয়তো আমরা ধরতে পারিনি।’ আসলে আমরা যে সমাজব্যবস্থা তৈরি করছি তা কতটুকু নারীবান্ধব, যে বিশ্ববিদ্যালয় কাঠোমো বানাচ্ছি, তাতে নারী শিক্ষার্থীরা কতটুকু সুরক্ষিত; যে পারিবারিক বলয় দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে তাতে নারীরা কতটুকু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে- এমন প্রশ্ন তোলা এখন তো আরো জোরাল হচ্ছে। সম্প্রতি যে আত্মহত্যাগুলো দেখা গেল তার মধ্যে চারজনের তিনজনই নারী। কাজেই এ থেকে অনুধাবন করা যাছে- এ সমাজ নারীর জন্য নিরাপদ নয়। সর্বোপরি, এ সমাজ নারীর জন্য কবে সুরক্ষিত হবে, কবে রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীর নিরাপত্তা করে নিশ্চিত করতে পরবে, কবে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত হবে- তা কি আমরা আদৌ নিশ্চিত করে বলতে পারি?

লেখক : বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত