খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মানসিকতা প্রয়োজন

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ প্রকাশ

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এই মুহূর্তে রাজনীতি বোঝেন না, অর্থনীতি জানেন না এমন কাউকে যদি তার জীবনের প্রধান সমস্যার কথা জানতে চাওয়া হয়, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথা নির্ভাবনায় বলে দেবেন। এ কথা মিথ্যে নয়, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কথা হচ্ছিল সরকারি কলেজের একজন সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে। গত জাতীয় বেতন স্কেলে তার মাসিক আয় অনেক বেড়েছে যা তিনি আশাও করেননি। তবে গত কয়েক বছরে তার ব্যয়ও বেড়েছে অনেক বেশি। কলেজপড়ুয়া এক সন্তানের শিক্ষা, নিজের খরচ, সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। তিনি আশায় আছেন, এখন আবার কবে নতুন বেতন স্কেল দেওয়া হবে। সঙ্গে তার হতাশা রয়েছে, বেতন বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরেক দফা বেড়ে গিয়ে আবার না তাকে বিপাকে পড়তে হয়! দেশে চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেলসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশ কয়েক দিন ধরে। আসন্ন কোরবানিতে পণ্যমূল্য আরো বাড়তে পারে বলে জনমনে আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু কিছু জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে এক দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্যের উন্মাদ হস্তিকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে। গম উৎপাদনকারী অন্যতম প্রধান দেশ ইউক্রেনে গম চাষ হয়নি বললেই চলে। তিন বছর ধরে কোভিডের ভয়াবহ সংক্রমণও বিশ্ব অর্থনীতির মূলে আঘাত হেনেছে। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্বের পণ্য বাজারে। আগামীতে চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্য আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কয়েক বছর আগে দেশে চাল ও খাদ্যপণ্যের ব্যাপক উৎপাদন মূল্য স্থিতিশীল থাকায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়াও কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনো অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক রাখা যায়নি। পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বিপদে ফেলেছে। আজকাল বাজারে বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য চাল প্রকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৯০ টাকায়। সরু চালের চেয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মোটা চালের দাম তুলনামূলক বেশি। আটা বর্তমানে কেজিপ্রতি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সব ধরনের ডালের দামও চড়া। এক লিটার খোলা ভোজ্য তেলের মূল্য ১২০-১৫০ টাকা। চিনি কেজিপ্রতি ১২০-১৫০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্নবিত্তের মানুষ কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। এ কথা সত্যি, দেশের একটি শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্য দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপ যেন তেমন কাজে আসছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব জিনিসের দাম কমে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ে না। বরং কোনো ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ জানে না। ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হবে। ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা কোনোমতে কাম্য নয়।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চালের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাতপ্রিয় বাঙালি বিপাকে পড়েছেন। এর আগে তারা ভাতের বিকল্প খাদ্যের চিন্তাভাবনাও শুরু করেছেন বেশ জোরেশোরে। এ নিয়ে অনেক আগে পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা, সভা-সেমিনার এমনকি শোভাযাত্রাও হয়েছে। আলু দিয়ে তৈরি নিত্যনতুন রেসিপির বাহারি সব খাবারের মেলাও বসেছে দেশের কোথাও কোথাও। কিন্তু বাস্তবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে ভাতের বদলে আলুর মতো বিকল্প খাদ্য গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। সে সময়ে আলুর বাম্পার ফলন হওয়ায় কম মূল্যে দীর্ঘ সময় আলু প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ছিল বাস্তবে তা হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ আলু পচে যাওয়ায় এবং অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মারপ্যাঁচে পড়ে আলুর দাম বেড়ে যায়। ফলে ভাতের বদলে কিছুটা হলেও আলু খাওয়ার বাসনাও মানুষের মনে স্তিমিত হয়ে আসে। হিমাগারে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ফি বছর অনেক আলু পচে যায়। এভাবে আলুর মূল্যও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়নি।

আমাদের এ দেশে ভাতের বিকল্প খাদ্যের প্রেসক্রিপশনের আগেও বহুবার এসেছে। ব্রিটিশ আমলে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষকে মোটা চালের ভাত খাওয়া ছেড়ে নাকি সরু বালাম চালের পোলাও খেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় এ অঞ্চলে বালামের চেয়ে মোটা চালের দাম নাকি বেড়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আগে এ দেশের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী খাদ্যসংকট মোকাবিলায় ভাতের বদলে বাঁধাকপি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা ছিল অনেকটা অবাস্তব। অবশ্য যে ঋতুতে যেসব সবজি কম দামে বিক্রি হয় তা বেশি করে গ্রহণ করা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের একটি পদক্ষেপ হতে পারে। এ কথা সত্যি, বছরের বেশ কিছু সময়ের জন্য চালের চেয়ে আলুর দাম বেশ কম থাকে, সে ক্ষেত্রে ভাতের বিকল্প হিসেবে পুরোটা না হোক অর্ধেক পরিমাণ আলু খেলে ব্যয় সাশ্রয় হবে। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের ওপরও চাপ কমবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভাতের বদলে আলু, ইয়াম, কাসাভা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এসবই মাটির নিচে উৎপাদিত মূলজাতীয় ফসল। এর উৎপাদন ব্যয়ও কম। আফ্রিকার অনেক দেশে ভাতের বদলে নিয়মিত আলুসিদ্ধ খাওয়া হয়। ইউরোপের অনেক দেশেও আলু প্রধান শর্করা জাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। স্থান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়, বদলাতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। খাদ্যাভ্যাস বদলানো কিছুটা কঠিন হলেও অসম্ভব কোনো কাজ নয়। ভাতের বদলে আলুর মতো শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হলে তাতে চালের চাহিদা কমবে।

আজ মাছ-মাংসের দাম চড়া। ডিমও সবসময় কম দামে পাওয়া যায় না। একবার তো ২০ টাকা হালি ডিম ৮০ টাকা হয়ে গেল। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে হঠাৎ এমন মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে চরম বেকায়দায় ফেলে দিল। চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল। তাতে কী! মাত্র কয়েক দিনে অসাধু মুনাফালোভী হাতিয়ে নিল মোটা অঙ্কের টাকা। সয়াবিন তেল নিয়েও চলেছে অসাধু কারবার। একই অবস্থা চলছে এখন পেঁয়াজ নিয়ে। ২০ টাকা কেজি পেঁয়াজের মূল্য এখন ১০০-এর কাছাকাছি। এমন কী কারণ হলো অস্বাভাবিক দাম বাড়ার! প্রতিটি পণ্যের এ ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী। এরা যখন খুশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে টাকা উপার্জনে সিদ্ধহস্ত। তা হলে অসহায় জনগণ কি করবে, কেমনে চলবে তাদের দিনকাল। পেঁয়াজের মতো জিনিস খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও অপরিহার্য নয় বলে সেটার ব্যবহারের পরিমাণ অর্ধেকে নিয়ে আসা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, একমাত্র ভাতই বাঙালির প্রধান খাদ্য হওয়ায় ১৭ কোটির অধিক মানুষের দেশে সবারই দুবেলা পেট পুরে ভাত খাওয়া প্রয়োজন এবং তা খেতে হলে চালের ওপর ভীষণ চাপ পড়ে। দেশে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ভর্তুকি দিয়েও চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা যায় না। আবার চালের দাম বেশি কমে গেলে কৃষক শ্রেণি পড়ে যায় মহাসংকটে। উৎপাদন ব্যয়ও তারা ঘরে তুলতে পারে না। চালের বিক্রয় মূল্য দিয়েই তো দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে তাদের জীবনের সব প্রয়োজন মেটাতে হয়। এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। ভাতের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ধীরে ধীরে আলু বা অন্য কোনো ধরনের শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হতে হবে। চালের বিকল্প হিসেবে ভুট্টা, গম এবং আলুর বিকল্প ইয়াম, কাসাভা চাষে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে এসব কৃষিপণ্যের আবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। দিতে হবে কৃষিঋণ সহায়তা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রধান খাদ্য হিসেবে দেশের জনগণ ভাত, আলু বা অন্য যা কিছু গ্রহণ করুক না কেন, তা থাকতে হবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। আর দেশের আপামর জনগণকে ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ভাত কম খেয়ে বেশি করে শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গ্রহণ করতে হবে। তবে ২০ টাকা উৎপাদনের শাকসবজির কেজি যাতে বাজারে এসে ৮০ টাকা হয়ে না যায়, তার বিহিত করতে হবে। আর দেশের কোটি মানুষের জন্য চালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে বাজার সিন্ডিকেট।