ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গবাদি পশুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রতিকার ও করণীয়

আকলামা শিকদার
গবাদি পশুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রতিকার ও করণীয়

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের মানুষের কৃষি কাজের এক সময়কার প্রধান হাতিয়ার ছিল গরু, মহিষ। এসব গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে কৃষক তাদের জমিজমার হালচাষ করে কৃষিকার্য নির্বাহ করতেন। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিতে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তাই এখন গরু, মহিষ দিয়ে হাল চাষ বা গাড়ি না টানলেও প্রতিটি কৃষকের ঘরে আছে এসব পশু ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশে গরু বা মহিষের খামার গড়ে তুলেছেন কিছু কৃষক বাণিজ্যিকভাবে। এ কারণে এদের যত্নও বেড়েছে দারুণভাবে। আগে কৃষকরা এসব পশুর যত্ন কীভাবে নিতে হতো তা জানতেন না। কিন্তু আধুনিকতার ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে কৃষকরা জানতে পারছেন গবাদিপশুর রোগ-বালাই হলে কী কী উপায়ে কোথায় গেলে এদের সুচিকিৎসা বা পরামর্শ পাওয়া যাবে। আর তাই এসব কিছু সহজলভ্য হওয়ার কারণে গবাদিপশু পালনও বৃদ্ধি পেয়েছে দারুণভাবে। মানুষের যেমন নানা রকমের রোগ-বালাই হয় তেমনি পশু-পাখিরও রোগ-বালাই আছে। বর্তমানে গরু, মহিষের এক ভয়াবহ রোগ দেখা দিয়েছে। যেটি কোনো পশুকে আক্রমণ করলে সহজে আর সে পশু বাঁচে না। লাম্পি স্কিন ডিজিজ। পশুর চামড়াঘটিত একটি রোগ। লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা মূলত গৃহপালিত গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে। প্রাণীর গায়ে ফোসকা দেখে প্রাথমিকভাবে এই রোগ শনাক্ত করা হয়। লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়িয়ে পড়লে গরু পালনের সঙ্গে জড়িত সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে প্রান্তিক খামারিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই রোগের ফলশ্রুতিতে গরু থেকে মাংস উৎপাদন এবং দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে আসে গর্ভপাত এবং অনুর্বরতার মতো বিষয়গুলো। লাম্পি স্কিন ডিজিজটি বিভিন্ন করণে ছড়াতে পারে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হতে পারে এক খামার থেকে অন্য খামারে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে গরু নিয়ে যাওয়া। মূলত এই গরু স্থানান্তরের মাধ্যমে অনেকদূর পর্যন্ত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর মশা, মাছির মাধ্যমে কাছাকাছি স্থানগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মূলত যে মশা, মাছিগুলো আক্রান্ত পশুর দেহ থেকে রক্ত পান করে তারাই এ রোগের জীবাণু বহন করে। একেক এলাকায় একেক ধরনের বাহকের মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। তবে এই রোগের ভাইরাসটি সাধারণত বাহকের শরীরে বংশবিস্তার করে না। সাধারণত সরাসরি স্পর্শের কারণে এই রোগ ছড়ায় না। প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার পর ভাইরাস রক্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তবে তা অল্প কয়েক দিন থাকে। অসুস্থ ষাঁড়ের বীর্যেও এই ভাইরাস থাকতে পারে। তাই এই ষাঁড় দিয়ে যদি প্রজনন করানো হয়, তাহলে গাভীটিও আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থ গাভী থেকে দুধের মাধ্যমে অথবা ওলানের বাঁটের ক্ষতের মাধ্যমে দুধ খাওয়া বাছুরকে আক্রান্ত করতে পারে। আক্রান্ত প্রাণীতে ব্যবহৃত নিডল (সুচ) যদি অন্য সুস্থ প্রাণীতে পুশ করা হয়, সেক্ষেত্রেও এই রোগ ছড়ানোর একটা আশঙ্কা থাকে। এ রোগে মৃত্যুর হার অন্তত ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ১৯২৯ জাম্বিয়া প্রথম অফিসিয়ালি শনাক্ত হওয়া এই রোগ ১৯৪৩ সাল থেকে ৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেক বছর এ রোগ দেখা না গেলেও বর্তমানে আবার এর প্রভার দেখা দিয়েছে দারুণভাবে। বাংলাদেশে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রথম দেখা দেয় ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে। এর পরই মাঠে নামে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তদন্ত টিম। তখন দেশের ১২ জেলায় ৪৮ হাজার গরুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এ বছর আবার এ রোগটি দেশের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশে ৪০ শতাংশ গরু এ রোগে মারা গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সূত্র সার্ভিস। এ রোগে আক্রান্ত পশু থেকে বিভিন্নভাবে অন্য পশু আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন পশু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন মশা ও মাছিকে এ ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কীট-পতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গরুর লালা গরুর খাবারের মাধ্যমে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গাভির দুধেও এ ভাইরাস বিদ্যমান। তাই আক্রান্ত গাভির দুধ খেয়ে বাছুর আক্রান্ত হতে পারে। গ্রামগঞ্জের প্রাণী চিকিৎসকরা এক সিরিঞ্জ ব্যবহার করে বিভিন্ন গরু-ছাগলকে টিকা দেয়। এতেও সিরিঞ্জের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসে আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেন প্রজননে ব্যবহার করলেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শুধু গরু, মহিষ ও ছাগল এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হয়। প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিপাইরেটিক ও অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। নডিউল বা গুটি ফেটে গেলে বা সেকেন্ডারি ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন দমন করার জন্য সিস্টেমিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া ফেটে যাওয়া গুটিতে যেন মশা-মাছি বসতে না পারে, সেজন্য ফ্লাই রিপিলেন্ট ব্যবহার করা যায়। তবে ২১ দিন পর সাধারণত এমনিতেই রোগটি সেরে যায়। তাই লাম্পি স্কিন ডিজিজ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেই দ্রুত উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা রেজিস্ট্রার্ড প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে অতি দ্রুত। পাশাপাশি আমরা যারা এসব পশু খামারি বা গৃহে অল্প আকারে কৃষির অংশ হিসেবে লালন-পালন করি তাদের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো প্রতিটি রোগের চিকিৎসা সহজলভ্য হলেও এই লাম্পি স্কিন রোগের চিকিৎসা সহজ নয়। এর আগেও পশু রোগটির আক্রমণ হলেও এ রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। তবে খামারের ভেতরের এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশা-মাছির উপদ্রব কমিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রান্ত গরুর খামারের শেড থেকে আলাদা করে অন্য স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখলে অন্য গরুতে সংক্রমণ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত