১৯৭১ সালে অপারেশন ‘সার্চলাইট’

নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর হামলা

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারের হত্যাকাণ্ড চালায়। ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হয়। ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম বা কোড নেম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ওই রাতে অর্ধ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। ২৫ মার্চ রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় ‘কালরাত’ হিসেবে। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে দুটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল, প্রথমত ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় এরই মধ্যে ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এর আগেই ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে পাকিস্তানি হানারদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এদেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এ রকম প্রেক্ষাপটে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলার মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়। এই অভিযানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ মার্চ। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছিল না। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনের’ জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন বলে তাদের জানানো হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় বসে রাও ফরমান আলী এবং তিনি মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। ‘জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পনা ছিল ১৬টি প্যারা সংবলিত এবং পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। পরিকল্পনা অনুমোদিত হলেও কবে সামরিক অপারেশন চালানো হবে সেই দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল না। সময় জানিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইনের কাছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে ফোনটি এসেছিল ২৫ মার্চ সকাল ১১টায়। সংক্ষেপে বলা হয়েছিল, ‘খাদিম, আজ রাতেই’। সময় নির্দিষ্ট হয়েছিল রাত ১টা। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে অবশ্য তখন ২৬ মার্চ। হিসাব করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ততক্ষণে নিরাপদে করাচি পৌঁছে যাবেন।

২৫ মার্চের রাতে হঠাৎ হামলা শুরু হয়। ২৫ তারিখ রাতের ঘটনার পরে ২৬ তারিখ কেউ পথে বের হতে পারিনি। ২৭ তারিখ বের হয়ে যে বীভৎসতা দেখা যায় তা আসলেই কারোর কল্পনাতেও আসেনি। এত লাশ একসঙ্গে দেখে বাংলার মানুষ ভয় পেয়ে যাবে ভেবেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু তারা ভাবেনি আসলে আত্মবিশ্বাস ভাঙার ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে উঠবে। ২৫ মার্চের বীভৎসতা দেখে স্বাধীনতাকামী মানুষ আরো দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করে।’ সেই সময়টা ছিল রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় ওড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এর আগে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রাজনৈতিক সমঝোতা ‘ব্যর্থ’ হলে সামরিক অভিযান চালিয়ে ‘পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের উপদেষ্টা। দুইজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছে না। যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনে’র জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আর সে কারণে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ১৮ মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় রাও ফরমান আলী এবং তিনি দুইজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দায়িত্ব নেন রাও ফরমান আলী, আর বাকি পুরো প্রদেশে অভিযানের দায়িত্ব নেন খাদিম হুসাইন রাজা। সন্ধ্যায় খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে তারা হাজির হন কমান্ড হাউজে। এভাবেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। বিশ্বের ইতিহাসে রচিত হয় বর্বরতার আরেকটি রাত।