ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২৬ মার্চ, রক্ত ঋণে আবদ্ধ বাংলাদেশ

২৬ মার্চ, রক্ত ঋণে আবদ্ধ বাংলাদেশ

ইতিহাস তা নয়, যা কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করে; ইতিহাস তা, সহস্রাব্দ পরেও যা নিজেই নিজেকে নির্ভুল বর্ণনা করে। ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত যে কোনো মহৎকর্ম অন্ধকারেও আলো ছড়ায়। প্রগৈতিহাসিক কাল হতে সভ্যতার ধারাবাহিকতায়, আত্মত্যাগের মূল্যায়ন, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে অমরত্ব লাভ করে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, জাতীয় ঐতিহ্য গত কারণে, এ সকল ঘটনাপ্রবাহ, যে কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়; বরং তা সময় বা কালের উপর বর্তায়। এ কারণেই মানবসভ্যতার প্রারম্ভিককাল থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত, সভ্যতার ধারাবাহিকতায় অসংখ্য ছন্দ পতনের পরও, মানবেতিহাসের প্রতিটি ধাপ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আজ তেমনি ঐতিহাসিক একদিন, যেদিন মহাকালের গর্ভে প্রসব বেদনার শুরু হয়ে দীর্ঘ ৯ মাস পর পৃথিবীর কোলে জন্ম নেয় শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ইতিহাস তা নয়, যা কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করে; ইতিহাস তা, সহস্রাব্দ পরেও যা নিজেই নিজেকে নির্ভুল বর্ণনা করে। ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত যে কোনো মহৎকর্ম অন্ধকারেও আলো ছড়ায়। প্রগৈতিহাসিক কাল থেকে সভ্যতার ধারাবাহিকতায়, আত্মত্যাগের মূল্যায়ন, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হয়ে অমরত্ব লাভ করে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, জাতীয় ঐতিহ্যগত কারণে, এসকল ঘটনাপ্রবাহ, যে কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়; বরং তা সময় বা কালের উপর বর্তায়।

আজ ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ৫৩ বছর আগে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দিবসটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালির জাতীয় জীবনে এ দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি-তত্ত্বের অপরিণামদর্শী ফর্মূলায়, ভারত-পাকিস্তান নামে দ্বিখণ্ডিত ভূখণ্ডে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, ৭১-এ ভূখণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট মধ্যরজনীতে, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিধেয়, খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিকতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে, শুধু ধর্মীয় মেলবন্ধনের ভিত্তিতে, হাজারো মাইলের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত বিজাতীয় দু’টি ভূখণ্ড এক সুতোয় না গেথে; দেশ ভাগের মহাযজ্ঞটি যদি বাস্তবতার নিরিখে করা হত, তাহলে হয়তো বা আজকের ‘২৬ মার্চ’ স্বাধীনতা দিবসের ইতিহাস অন্যরকম হতে পাড়ত।

একশত নব্বই বছরের ব্রিটিশ দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত জাতি, এক বছর যেতে না যেতেই পাকিস্তানি বৈষম্যের উপলব্ধি আঁচ করতে শুরু করে। ’৪৭-এর দেশ ভাগের পর ৪৮ সালেই প্রথম, মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায়, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে নিতন্ত বাধ্য হয়ে প্রতিবাদী মেজাজে গা ঝারা দিয়ে, জানান দিতে হয় যে, আমরা আছি, ইচ্ছে করলেই তোমরা যাচ্ছে তাই করতে পার না। সে দিনের ভাষা রক্ষা আন্দোলনই যে, পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে, পর্যায়ক্রমে তা স্পষ্ট হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বিমুখী নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরিতে নিয়োগ, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন বাজেট, বিনিয়োগ বৈষম্য, সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ, সিভিল এডমিনিস্ট্রেশনসহ সব ক্ষেত্রে পূর্বপাকিস্তানকে শোষণের উপনিবেশে পরিণত করে পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার। সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা। রাষ্ট্রীয় সকল পরিকল্পনা প্রণীত হত কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি না থাকায়, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী মহল, কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। সম্পদ বিভাজন বৈষম্যের ক্ষেত্রে প্রতিবাদের সুযোগ না থাকায়, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্ভাবিত ফর্মূলা ছিল, গোটা পাকিস্তানের যে কোনো অংশে উন্নয়ন বা বিনিয়োগ সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য উন্নয়ন বলে বিবেচিত হবে। এ অবাস্তব কল্প তত্ত্বের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত প্রকল্পগুলোতে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বৈষম্য নীতি অনুসরণ করে তারা। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর হতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মোট তিনটি পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। প্রথম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনাটি ছিল ১৯৫৫/৫৬ সাল হতে ৫৯/৬০ সাল পর্যন্ত। এ পরিকল্পনায় পূর্ব-পাকিস্তানের উন্নয়নে সোয়া তিনশত কোটির কিছু বেশি রুপির বরাদ্দ দেয়া হয়; যার মাত্র সোয়াশ কোটি রুপি ব্যয় করা হয়েছিল। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৫০০ কোটি রুপি। অথচ জনসংখ্যা অনুপাত ও প্রধান রপ্তানি আয়ের উৎস পাট ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার। এভাবে প্রতি বছর কম করে হলেও চার পাঁচশত গুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হত পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায়ও একই কৌশলে বৈষম্য নীতি বাস্তবায়ন করা হয়। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এহেন কর্মকাণ্ডে এরইমধ্যে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। একই পদ্ধতিতে তৃতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার নকশা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে, বজ্র কঠিন প্রতিবাদের মুখে, আইয়ুব খান উভয় অঞ্চলে বৈষম্য নীতি অবসানের ঘোষণা দিয়ে একটি অর্থ কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির রিপোর্টে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সম্পদ বিভাজনের কথা বলা হলেও, পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অর্জিত অর্থ কৌশলে ব্যায় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়নে।

এতকিছুর পরও দুই পাকিস্তান একীভূত থাকার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয়দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু আইয়ুব খান তা মানতে রাজি না থকায়, এই ছয়দফাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। মূলত এই ছয়দফাই দুই পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরিণতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ লাগাতার ২৩ বছর ধরে স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন থেকে অবশেষে একদফা স্বাধীনতা আন্দোলনে রুপ নেয়। যার ধারাবাহিকতা ছিল, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, সবশেষে ’৭১-এর ৭ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে, প্রায় ১০ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে তেজ দীপ্ত কণ্ঠে ‘এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগাম’ এর ডাক দেন। তার কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে সুকৌশলে জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতির আহ্বান জানান তিনি। জনসভায় উপস্থিত দেশি-বিদেশি মিডিয়া ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যা বুঝে নেয়ার, তা বুঝে নেয়।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর দেশের মুক্তি পাগল জনতা ভেতরে-বাইরে যে যার মত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার প্রশাসনিক ছদ্মাবরণে পূর্বপাকিস্তানের সামরিক আধাসামরিক অস্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকল ব্যক্তিবর্গকে নিরস্র করার কৌশলী নীতি গ্রহণ করে। চট্টগ্রামবন্দরে সামরিক সরঞ্জামের চালান খালাস হতে শুর হয়, অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে। একদিকে সরকারি বৈধতার সুযোগে পাকিস্তান সামরিক শক্তির বাঙালি দমন অভিযানের প্রস্তুতি, অন্যদিকে নিরস্র বাঙালির কোমড়ে গামছা আর হাতে বাঁশের লাঠির অপ্রচ্ছন্ন মহড়া। মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে, ২৫ মার্চ দিবাগত-রাত, অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর শুরু হয়, ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর চালানো রক্তের হোলিখেলার ধারা গিয়ে মিশে বুড়িগঙ্গার জলস্রোতে। বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়ে চট্টগ্রাম বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কালবিলম্ব না করে বাঙালি জাপিয়ে পরে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মাতৃভূমি রক্ষার মুক্তির স্বাধীনতা যুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ। অর্ধশতাব্দী পেড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের আজ ৫৩তম দিবস। আত্মমর্যাদার প্রশ্নে সঙ্গত কারণেই ব্রিটিশ দাসত্ব ও পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা রক্ত দিয়েছি। দেশের জন্যে মা তার সন্তান, নববধূ স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছে, সন্তান পিতাকে হারিয়ে এতিম হয়েছে। অনেক পরিবার সর্বস্ব হারানোর পরও শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে। কেউ বা পরিবারের শহীদের চূড়ান্ত গন্তব্যের ঠিকানা পর্যন্ত জানে না। অজানা কোনো বৈধ্য ভূমিই হয়তো তাদের শেষ ঠিকানা। তা হোক! দেশের জন্যে জীবন দিয়ে গেছে, তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন আছে বৈকি! যার উত্তর দেয়ার কেউ নেই! এটা কি সেই দেশ? যার জন্য রক্ত দিয়েছে এদেশের মানুষ? এটা কি সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা, যার জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছে আমার মা-বোন? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে আকা ছবির মতো দেশ কি এটাই? নাহ:, মোটেই না! সর্বত্র কি দেখছি এসব? যে দাষত্ব ও বৈষম্য মুক্তির লোভ দেখিয়ে মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ প্রাণ বিসর্জিত হয়েছিল, কোথায় সেই দেশ? একটা ভূখণ্ড অর্জনই কি স্বাধীনতা? বলতে দ্বিধা নেই, ‘আমরা রক্তঋণে আবদ্ধ এক বাংলাদেশ’।

এএইচ খান রতন

লেখক : কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত