বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার জাকাত তহবিল গঠন সম্ভব

এসএম মুকুল

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব নয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। আমাদের দেশে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অগণিত সফল ব্যবসায়ী, বিত্তবান, ধনাঢ্য, শিল্পপতি রয়েছেন, যাদের কাছে কোটি কোটি টাকা এখানে সেখানে গচ্ছিত অলস অবস্থায় বছরের পর বছর পরে থাকে। সমাজের সকল ধনী মানুষেরা যদি গরিব মানুষের কল্যাণে তাদের অর্জিত অতিরিক্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত হিসেবে ব্যয় করেন, তাহলেও দারিদ্র্যবিমোচনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ’র নির্বাহী পরিচালকের একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, সঠিকভাবে দেশের বিশ লাখ ধনীর কাছ থেকে জাকাত সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠণ করা সম্ভব হতে পারে। তিনি আরো বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে, গরিব-ভিক্ষুক পুনর্বাসনে জাকাত তহবিলের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা নেয়া হলে এক দশকেই দেশের দারিদ্র্যমুক্তি সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরাও এ বিষয়ে এখন একমত। সরকারের শত শত কোটি টাকার বাজেট থাকে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়নে। কিন্তু জাকাতের মতো বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিকটি আমাদের সরকার কখনো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেননি।

অভিযোগ আছে, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাধীন সরকারের একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান ‘জাকাত বোর্ড’। এই জাকাত বোর্ডের আসলে কাজ কী এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। কারণ দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত বোর্ডের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। জাকাত বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতেও তাদের কোনো ভুমিকা নেই। তাদের নাম শোনা যায় বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখা আর রোজার মাস শুরু সময় এলে। আমরা দেখছি- এনবিআর ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ে বহুমুখী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কর প্রদানে রাষ্ট্রের উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টিতেও ভুমিকা রাখে। জাকাত বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন কর আদায়ের মতো জাকাত আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট দেশ বা মুসলূম দেশ। একটি মুসলীম দেশে ইসলামের বিধান অনুসারে জাকাতভিত্তিক অথ্যনৈতিক ব্যবস্থপনা থাকাটাই স্বাভাবিক। এখানে জাকাত আদায়ের লক্ষ্যে সক্ষম ধনীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে বিভাগ, জেলা ও থানা ভিত্তিক জাকাত আদায় কমিটি গঠণ করা যেতে পারে। তবে জাকাত নিয়ে যেন আবার জারিয়তি না হয় সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

বিশ্বের র্শীষ ১০০ ধনী বছরে যে আয় করে তা দিয়ে বিশ্বের চরম দারিদ্র্য চার বার দূর করা সম্ভব। ‘দ্য কষ্ট অব ইনইকুয়ালিটি : হাউ ওয়েলথ এন্ড ইনকাম এক্সট্রিমস হার্ট আস অল’ শিরোণামে ব্রিটেন ভিত্তিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম তাদের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, শীর্ষ ১০০ জন ধনীর কাছে তার চার গুণ অর্থ রয়েছে। অক্সফামের গবেষণা বলছে- অল্প কিছুসংখ্যক লোকের সীমাহীন সম্পদ দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতাও আসলে তা-ই।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ অথবা দুরারোগ্যব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে সহায়তা চাওয়া হলে দেশে বিত্তবান মানুষেরা সাগ্রহে এগিয়ে আসেন। তাতে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মানবিক ও ধর্মীয় অনুভুতি যথেষ্ট সক্রিয়। একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন নীতিমালায় স্বচ্ছতার সাথে জাকাত আদায় এবং আদায়কৃত জাকাতের অর্থ ব্যবহার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দেশের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষন সম্ভব হলে প্রতি বছর হাজার কোটি জমা হবে এই ফান্ডে। ভারতে পিস টিভি অব ইন্ডিয়া পরিচালিত হচ্ছে জাকাতের সহায়তায়। অতএব বাংলাদেশেও জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে- দারিদ্র্যবিমোচন, পথশিশুদের আবাসনভিত্তিক শিক্ষা, এতিখানা, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা, বিপথগামীদের আলোকিত পথে নিয়ে আসা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, আত্মকর্মসংস্থান প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। আর এসব কার্যক্রম নিজস্ব প্রচার সৃষ্টি করে যেমন পত্রিকা, চ্যানেল এসবে প্রচার করা হলে ্একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আদল পরিপূর্ণ হবে। এসব করতে গেলে জাকাত বোর্ডকে আরো ক্ষমতাসীন করতে হবে।

আমাদের জানা আছে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে পবিত্র ইসলাম ধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে বহুবার সরাসরি জাকাতের কথা বলা হয়েছে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে- ৮৫ শতাংশ মুসলমানের দেশে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে ৫ বছরে দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলা হয়েছে- দেশে ৫ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের নিজস্ব সম্পদ বলে কিছু নেই। আবার ২৭ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের মালিকানায় সম্পদের পরিমাণ এক একরের কম। পক্ষান্তরে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ভোগ-দখলের উপজীব্য হয়ে আছে ৯৫ শতাংশ সম্পদ। দেশের মোট জমির ৮০ ভাগ এই শ্রেণীর দখলে! একভারও ভাবা হয়, কি প্রয়োজন আছে এত বিত্ত-বৈভবের? কত টাকা প্রয়োজন একজন মানুষের এক জীবনে? এর কোনো উত্তর কী আছে?

ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক সমাজ গঠন ও দারিদ্র্য বিমোচনে একটি ইসলামিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির নাম জাকাত। ইসলাম ্একটি চূড়ান্ত জীবনবিধান। তাই পবিত্র কুরআন মজিদে নানা প্রসঙ্গে নামাজের মতোই জাকাতকে বাধ্যতামূলক ফরজ ইবাদতরূপে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসলামের জাকাত দর্শনের মূল বক্তব্য হলো- গরিব মানুষের পুনর্বাসন এবং স্বাভাবিক জীবনের পথ তৈরি করে দেয়া। ইসলামের পরীক্ষিত অর্থনৈতিক দর্শন জাকাত ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হলে সামাজিক বৈষম্য, হানাহানি, সংঘাত এবং অপকর্ম কমে আসবে। জাকাতে টাকায় যদি গরিব-ভিক্ষুক-আশ্রয়হারাদের পুর্ণবাসন ও রোজগারী ব্যবস্থা করে দেয়া হয় তাহলে ভিক্ষুক হয়ে কেউ পথে নামবে না। য়িন্নমূল মানুষদের যদি উৎপাদনশীল কাজে লাগানো হয় তাহলে রাস্তায় ছিনতাইকারীর ভয় থাকবে না। বাড়ি-ঘরে চুরি-ডাকাতির উপদ্রব কমে যাবে। অর্থাৎ, জাকাত এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করবে যেখানে বঞ্চিতরাও বাঁচবে, অপেশা-অপকর্ম ছাড়বে। ফলে আপনিও বাঁচবেন, স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারবেন সবাই।

সম্পদ শুধুমাত্র ধনীদের মধ্যে আবর্তিত হলে সামাজিক বৈষম্য কখনো কমবেনা। দ্রারিদ্র্য বিমোচনও সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে জাকাত হলো একটি বুনিয়াদি অর্থনৈতিক দর্শন। মানুষ যত ধনীই হোক- তাকে চারপাশের মানুষের কথা ভাবতে হবে।