স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং শিশু-কিশোরের পরিবর্তিত মনোজগত

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে স্মার্টফোন এখন প্রতিটি ঘরেই। এসব ডিভাইসে এরা এত বেশি সময় ডুবে থাকে অনেক সময় তা তাদের জন্য শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণও হতে পারে। তারপরও এখন আমরা তাদের এর থেকে দূরে রাখতে পারি না। কারণ আধুনিক যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। একাকিত্ব কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোনকে। ফলে এর খারাপ দিক হিসেবে তা ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আবার মোবাইল গেমস খেলে পরিবারের সদস্যের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। অর্থাৎ তাদের মনোজগত পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের দেশেও বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিশু কিশোর আছে যাদের চোখ সারাক্ষন ফোনে আটকে থাকে। তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে এমনকি বন্ধুদের সাথেও সময় কাটাতে পছন্দ করে না। তারা বিভিন্ন গেমে আসক্ত থাকে। আসক্ত শব্দটি তখনই বলা হয় যখন তা নেশায় পরিণত হয়। অন্য স্বাভাবিক কাজ বাদ দিয়ে যখন একটি বিষয় নিয়েই সে মেতে থাকে সেটাই আসক্তি বলা হয়। আজকাল হাতের মোবাইল ফোন যেন আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে পরিবারের সব সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করছে। এক ধরনের দুরত্ব তৈরি হচ্ছে। তাদের সারাক্ষণ চোখ আটকে থাকছে মোবাইল ফোনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের শেষের দিকের প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে দেশে ৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সি মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৫.৯০ শতাংশের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন রয়েছে। এ হার পল্লিতে ৫২.৪৮ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৬৩.২২ শতাংশ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এখানে বলা হয়েছে, দেশের ৮ কোটি ৩৬ লাখেরও বেশি শিশুর রয়েছে নিজস্ব মোবাইল ফোন যেখানে ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সী মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৮ কোটি ২৪ লাখের কিছু বেশি মানুষের আছে নিজস্ব মোবাইল। ২০২২ সালে হওয়া এ জরিপে লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ওই বয়সীদের মধ্যে ৬৬.৫৩ শতাংশ ছেলে ও ৪৫.৫৩ শতাংশ মেয়ের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন রয়েছে। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ হার ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬২.০৭ শতাংশ এবং সিলেটে সর্বনিম্ন ৪৭.৫৬ শতাংশ। এছাড়া জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, দেশে ৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সি মোট শিশুদের ৩০.৬৯ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যা পল্লিতে ২৫.৭৩ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৪১.৩০ শতাংশ। লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ে একই বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৮.০৪ শতাংশ ছেলে ও ২৩.৫২ শতাংশ মেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ হার ঢাকায় সর্বোচ্চ ৪০.৪২ শতাংশ ও রংপুরে সর্বনিম্ন ১৭.৬৯ শতাংশ। যাকে বেশ আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহার করলে তাদের সামাজিক দক্ষতা কমতে পারে, মোবাইলের আসক্তি হতে পারে, চোখের ওপর চাপ পড়বে, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাবে, শরীরের হাড় ক্ষয় হবে, ঘাড়ে ব্যথা হবে, আগ্রাসী আচরণ করবে, এমনকি তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনেও সমস্যা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আধুনিক এ সময়ে মোবাইল-ইন্টারনেটের ব্যবহার একেবারে বন্ধ না করে বরং তাদের সময় বেধে মোবাইল ও ইন্টারনেটের কার্যকরী ব্যবহার শেখানোর পরামর্শ দিচ্ছেন এই দুই বিশেষজ্ঞ।

এর ফলে তাদের মানসিক যে পরিবর্তন ঘটছে তা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্যণীয়। এর মধ্যে রয়েছে তাদের খিটখিটে ভাব, সাড়া না দেওয়া বা মোবাইল থেকে তার মনোযোগ ফেরালে রুঢ় আচরণ করা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকরাও এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে। তারা না পারছে মোবাইল থেকে দূরে রাখতে আবার না পারছে মোবাইল দিতে। এ সময়ের অভিভাবকরা উভয় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কখনো ইন্টানেরট জগতে আবার কখনো আধুনিক সব গেমসে মজে থাকছে সারাক্ষণ। ইন্টারনেটভিত্তিক গেমসেরও আজকাল অভাব নেই। অভিভাবক চাইলেও সন্তান যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোনোভাবেই সেখান থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে পারেন না। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের আচরণ ও অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। সেই পরিবর্তন কতটা ইতিবাচক তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। প্রশ্নের মূল কারণ হলো খেলা থেকে নেশায় পরিণত হওয়া এসব ডিজিটাল খেলার কুফল আমাদের সন্তানদের ওপর সরাসরি পরছে। কম্পিউটারের যুগ থেকে বেরিয়ে আমরা এখন মূলত স্মার্ট ফোন যুগে প্রবেশ করেছি। আমরা আগের চেয়ে বেশি একা, আত্নকেন্দ্রীক এবং অহংকারী। আজকাল উঠতি বয়সী সব ছাত্রছাত্রীর হাতেই স্মার্ট ফোনের দেখা মেলে। যার সবই এন্ড্রোয়েট চালিত। ছোটখাটো একটা কম্পিউটার নিয়ে ওরা সবসময় ঘুরে বেড়ায়। এতদিন সবাই কম্পিউটার গেম খেলায় আসক্ত ছিল। এখন মোবাইল ফোনেই ঘন্টার পর ঘন্টা গেম খেলে যায় বা ভিডিও দেখে অথবা অন্য কাজ করছে যা অপ্রয়োজনীয়। চোখ একটুর জন্য সরে না। এতটা নেশায় পেয়ে বসে এসময়। এটা কিছুটা নেশার মত হয়ে গেছে বলে অভিভাবকরাও আজকাল খুব বকাঝকা করেন না। বাসে রেলে যেখানেই তাকান দেখা যাবে উঠতি বয়সি পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মোবাইলে দেখায় ব্যস্ত। নিত্য-নতুন মোবাইল এবং বিভিন্ন অ্যাপস ও প্রোগ্রাম বা ইন্টারনেট ঠিকই কিশোর মনে প্রভাব ফেলছে। অনেক গেমস রয়েছে যা মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায় না ঠিক কিন্তু আসক্তি ঠিকই জন্মে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় এসব। কিন্তু আমরা তাদের এখান থেকে ফেরাতে পারছি না।

আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি আমাদের অলস আর চিন্তা বিমুখ করে তুলছে মোবাইল গেমস। স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে ইন্টারনেট গেমসের ওপর ঝুঁকছে। এসব গেমসের থাকে টুর্নামেন্ট এবং জয়ী হলে মোটা অংকের অর্থ পুরষ্কার। এই অর্থের লোভ থেকে বেরিয়ে আসা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু কিশোরদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যায়। এক বন্ধু যদি খেলে তাহলে তার দেখাদেখি অন্য বন্ধুও সেই গেমসে মেতে উঠছে। এভাবে এক হাত থেকে অন্য হাতে গেমসের কথা ছড়িয়ে পরছে। অচেনা একদল খেলোয়াড় মিলে একে অন্যের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে গেমের ভেতরে ঢুকে পরে সে।

পারিপাশির্^ক জগতের দিকে তার কোনো খেয়াল থাকে না। মোবাইলের পর্দার জগতের মোহে তারা বাস্তবতা ভুলে যাচ্ছে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতারও ওপরও প্রভাব পরছে। বিশ্বের অনেক দেশে বা অঞ্চলে কিছু গেমস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটা অন্তর্জালের যুগ। শিশুকাল থেকে আমরা সবাই খেলাধুলা করেই বড় হয়েছি। তবে সেসব খেলা আর আজকের খেলার ধরণ এক নয়। আমাদের সময় খেলার স্থান ছিল ঘরের বাইরে। আজকের যুগে খেলার স্থান ঘরে। ক্রিকেট আর ফুটবলের বাইরে সব খেলাই হয় মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রীনে। খেলাধূলা করার মাধ্যমে শিশু মনের বিকাশ সাধন ঘটে। খেলাধূলা করার জন্য প্রকৃতির সাহচর্য অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমানে প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ যেমন কমে গেছে তেমনি কমে গেছে খেলাধূলা করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা।

আমরা যদি আজকের প্রজন্মের দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখা যাবে যে এখনকার শৈশব একটি নির্দিষ্ট সময় এবং নির্দিষ্ট বৃত্তে বন্দি। ওদের খেলাধুলা করার জায়গাগুলো ক্রমেই ইট-কাঠের ক্রংকিটের নিচে চাপা পরছে। ফুটবল খেলতে চাও তার জন্য মোবাইল ফোন আছে, ক্রিকেট খেলাও মোবাইলে হচ্ছে। এসব গেমসের ভিড়ে যুগের সাথে সাথে আরো আধুনিক এবং রোমাঞ্চকর গেমসের আবির্ভাব ঘটছে। এসব গেমসে যেমন কিশোর সমাজ বুঁদ হয়ে থাকছে তেমনি তাদের অবসর সময়ের বড় অংশ মোবাইলের পেছনে ব্যয় করছে। এসব গেমস ক্রমেই গৃহবন্দি শৈশব প্রাণবন্ত করে তুলতে মোবাইলের দিকে ঝুঁকছে। প্রাথমিকভাবে এসব শিশু কিশোররা মনে করছে যে এতে তাদের কোনো খারাপ হচ্ছে না। তবে ক্রমেই তারা এতে আসক্ত হয়ে পরছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখন যা হচ্ছে তা হলো হাতে মোবাইল নিয়ে সারাক্ষণ তা চোখের সামনে ধরে রাখা। এমনকি পড়ালেখা করার সময়েও গেমস খেলায় ব্যস্ত থাকে। আর কিছু কিছু মারাত্মক খেলা তো জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আমরা প্রযুক্তির উৎকর্ষে এতটাই শীর্ষে পৌছে গেছি যে এখান থেকে বের হয়ে আসাও সম্ভব নয়। ফলে একমাত্র উপায় নিয়ন্ত্রণ করা। নিজের সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাকে বেশি বেশি সময় দেয়া। সন্তানের সাথে গল্প করা। তাকে উৎসাহ দেয়া এবং মাঠ বা খোলা স্থানে নিয়ে খেলাধুলা করা। সন্তানকে মোবাইলের জগত থেকে, ক্ষতিকর গেমসের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে বাবা-মাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।