রাজাকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত

কাজটি কঠিন তবুও দায়বদ্ধতা থেকে করা উচিত

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতার মাস মার্চ শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর এই মাসটি এলে মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তাভাবনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমরা নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যদিয়ে মাসটি অতিবাহিত করি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। এই মুক্তিযুদ্ধে যারা মনেপ্রাণে অংশ নিয়েছিলেন তারা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের আমরা জাতির কলংক বলে মনে করি। তবে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুুদ্ধে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। যারা বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের তালিকা সরকার করেছে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারা রাজাকার হিসেবে সমাজে পরিচিতি পেয়েছে। এসব রাজাকারের একটা আংশিক তালিকা করা হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো করা হয়নি। কবে নাগাদ রাজকারদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণনয়ন করা অত্যন্ত জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার যাদের রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, তাদের বেতন-ভাতা দিয়েছে তাদের তালিকা জেলা প্রশাসকের অফিসে থাকলেও সেই তালিকা ধরে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এই তালিকা প্রণয়ন করা গেলে জাতি হিসেবে আমরা স্বস্তি লাভ করতে পারব।

স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরও রাজাকারদের পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা করতে না পারা রীতিমতো লজ্জা-ক্ষোভ ও অপমানের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। আড়াই লাখ মা বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মুক্তিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া এ দেশের কোনো মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেননি। অথচ রাজাকারদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজ পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হলনা। কেন সম্ভব হলো না, সে কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। টানা চার বছরের মতো দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে দলটি। এই সময়ে যদি রাজাকার কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর নামের তালিকা প্রণয়ণ করা না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের বাইরের কোনো সরকার এই মহৎ কাজটি করবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সংশয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রতি বছর ২৬ মার্চ এলেই তালিকাগুলো চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এত বছরেও তা সমাপ্ত করার কোনো ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা বা আর্কাইভ করার মতো প্রয়াসও আর তেমন নেই বললেই চলে। এই বিশেষ কাজটি সময় মতো কেন করা হয়নি, তার জবাবদিহি করার কেউ নেই। অথচ ২০০৯ সাল থেকে দেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। কার্যত রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো এক ধরনের ধোঁয়াশা চলছে। রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযুেেদ্বর চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ ক্ষুব্দ। কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, রাজাকারের তালিকা কেউ করতে চায় না। ৭২ সালের তালিকা তো আছেই। এছাড়া নতুন করতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়বে। অনেকে এগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন। বাস্তবে কেউ এ তালিকা করায় আন্তরিক নন বলেও কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলা হচ্ছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকাই প্রকৃত তালিকা। কারণ রাজাকারদের তালিকা তো তৎকালীন সরকার প্রণয়ন করেছে এবং রাজাকারদের তারা বেতন-ভাতা দিত। নতুন করে তালিকা করতে গেলে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। তাই পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা তালিকাকে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা।

এই ধরনের তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় যা পাকিস্তান সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি কোনো লিখিত তালিকা জমা দেয়নি বলে জানা গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে ১৯৭১ সালে অনেকে বাধ্য হয়ে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছে তাদের সংজ্ঞা কি হবে? আর যারা প্রকৃত রাজাকার ছিল, তারা তো পাকিস্তানিদের তালিকায় ভাতাভোগী। বিষয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সংকট রয়েছে। দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে ১৫০টি উপজেলার রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। আরও যাচাই-বাছাই হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে আংশিক তালিকা প্রকাশ না করে একসঙ্গে সব রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে। কারণ আংশিক তালিকা প্রকাশ করলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। ৫৩ বছর হয়ে গেছে। অনেকে অনেক কিছু ভুলে গেছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের নাম এসেছে তাদের সময়কার সাক্ষ্য লাগবে। এখন সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যাচাই- বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে হবে। তাই কাজটি বেশ জটিল। তবে এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিিিধ সম্পর্কে অবহিত করার মধ্যদিয়ে কোন কোন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। বর্ডারের চোরকারবারীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান আর্মির গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে।

নির্ভুল তালিকা করতে হলে অনেক বছর সময় লাগবে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তালিকা করতে হবে। বাস্তবে কাজটা বেশ কঠিন। তবে একে বারে অসম্ভব নয়। একজন আসল রাজাকার বাদ যাবে অথচ একজন ভালো লোকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসুক সেটাও কাম্য নয়। সব উপজেলার রাজাকারের নাম না পাওয়া এবং অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা আত্মীয়স্বজনরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো অবশ্য জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরো দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন-হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে তারা। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ওই তালিকায় রাজাকার নয এমন মানুষের নাম চলে আসে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন-২০২২ সংশোধিত আকারে পাশ হওয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর মধ্যে রাজাকারের তালিকা তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয় জামুকাকে। আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছেন অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য জামুকা সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজাকারের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হলে অনেকে জানিয়েছেন তাদের জেলার রেকর্ড রুমে রাজাকারদের নামের কোনো তালিকা নেই। কমিটির সদস্যরা জেলা ও উপজেলায় গিয়েও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। অনেকে শত্রুতা করে কারও নাম দিতে পারে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।