ভিক্ষাবৃত্তি ও ইসলামী সমাজব্যবস্থা

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোনো প্রকার রাখঢাক আর ভূমিকার অবতারণা না করেই জীবন বিধান আল কোরআন একাধিক আয়াতে ধনীর অর্জিত, প্রাপ্ত সম্পত্তিতে গরিব, নিঃস্ব ও অভাব গ্রস্তদের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আশির চেয়েও বেশিবার জাকাত প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেছেন আল্লাহপাক আল কোরআনে। এ ব্যাপারে আল কোরআনের আদেশের ভাষাও অকাট্য ও কঠোর যেমন ওদের সম্পদ ও সম্পত্তিতে ভিখারি আর নিঃস্বদের হক অবশ্যই রয়ে গেছে। আবার আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে আল কোরআন স্বাভাবিক দান খয়রাত, সাহায্য সহযোগিতার হাত এমন ব্যক্তির দিকে বাড়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছে, যে অভাব গ্রস্ত, মাঝ পথে আটকে যাওয়া লাজুক মানুষটি যে কারও কাছে হাত না পাতে- আবার তার চাল চলনে অভাব অনটনের তেমন ছাপ লক্ষিতও হয় না অথচ সত্যিকার অর্থে সে দারুণ ভাবে বাধাগ্রস্ত, তাকেই দান করাই মানবিক কর্তব্য।

আল কোরআনের প্রথম সুরার প্রথম অধ্যায়েই দান করাকে (ক্ষমতানুযায়ী) ইমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমনভাবে করা হয়েছে নামাজ আদায় করাকে। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তির কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি মানুষের মানবিক সম্মানীয় গুণগুলোকে ধ্বংস করে আলস্যের দুয়ার খুলে দেয়। তাই জীবন বিধান আল কোরআন যেখানেই নামাজের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে জাকাতের নির্দেশও প্রদান করেছে। তাছাড়া আল কোরআন উৎসাহ প্রদান করেছে বিভিন্ন ধরনের দানে। যেমন রোজার কাজা স্বরূপ গরিব-দুঃখীদের খাদ্য বিতরণ। মহানবী (স.) বলেছেন, ছদকা (বিশেষ দান) বিপদ সংকটকে দূর করে, দাতার আয়ু বৃদ্ধি করে ইত্যাদি।

একদিকে মহানবী বয়তুলমাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) প্রতিষ্ঠা তথা তার মাধ্যমে জাকাত উশর ইত্যাদির বাস্তবায়ন করেছেন তেমনি সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভেঙ্গে নামাজের জামাতের সারিতে সবাইকে সমমর্যাদার অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সদাতৎপর ছিলেন। অপরদিকে কাউকে ভিক্ষা করতে দেখলে তাকে কাজে লাগিয়ে দিতেন, কাজের পরামর্শ প্রদান করতেন। একবার এক ব্যক্তিকে ভিক্ষা করতে দেখে, তাকে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন তার ঘরে কী কী জিনিস আছে। লোকটি তার উত্তরে জানাল, যে তার শুধু একটি কম্বল আছে। তিনি তা সংগ্রহ করে বিক্রয় করিয়ে তার মূল্যের কিছু টাকা দিয়ে কুড়াল কিনে দিয়ে বললেন পাহাড় থেকে কাঠ কেটে তা বাজারে বিক্রয় করে পেট চালাও এবং যেদিন তা পারবে না, সে দিনের জন্যও কিছু টাকা তার হাতে গুজে দিয়ে বলে দিলেন আগামীতে যেন তোমাকে আর ভিক্ষা করতে না দেখি।

আমাদের অনেকে সত্যকে জানতে ভালবাসেন; কিন্তু যে সত্য বিকৃত ধর্মবিশ্বাসের বাহন হয় তার প্রকাশ করা আমরা বরদাস্ত করি না। ইতিহাস বড়ই নির্মম, নিষ্ঠুর, কঠোর- তা তার একান্ত ভক্তজনকেও রেহাই দেয় না।

আমাদের বিশ্বাস মহানবীর সাহাবীরা লক্ষ্য ও চরিত্রের দিক থেকে উন্নত এবং মানবিক গুণসম্পন্ন ছিলেন কেউ কেউ মানবিক দুর্বলতার শিকারও ছিলেন। সৃষ্টিগত কারণে তারাও ক্ষুৎ পিপাসার অধীন ছিলেন, এমনকি যৌনতা যা মানুষের জৈবিক চাহিদা তা তাদের প্রাকৃতিক কারণে বেশিই ছিল কারণ তারা ছিলেন মাংসভোজী। মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে, দোহাই তোমরা আমার সাহাবীদের দোষ অনুসন্ধান করো না, তা কিন্তু ছিল ঐচ্ছিক নির্দেশ। যাই হোক মহানবীর একজন সাহাবী যার নাম ছিল কিরকিরা। একবার চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে গেলে তাকে মহানবীর সম্মুখে উপস্থিত করা হলে তিনি আল্লাহর কিতাব আল ক্বোরআনের আদেশ কার্যকরী করলেন। বললেন ওর দু’হাত কেটে দাও। ওকে হাত কাটতে নিয়ে যাওয়া হলে আদেশ দাতাকে কাঁদতে দেখা গেল। সাহাবীরা তার কারণ জানতে চেয়ে বললেন আপনি তো ওকে হাত কাটার নির্দেশ না দিয়ে বরং দোওয়া করে ওর পাপ মোচন করিয়ে নিতে পারতেন। মহানবীর উত্তর ছিল বড়ই গভীর-তিনি সে দিন বলেছিলেন, আমি ওর জন্য কাঁদছি না, বরং আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি যে, তোদেরই জামাতের, মিল্লাতের একজন চৌর্যবৃত্তিতে পা দেওয়ার অবস্থায় উপনীত হলো, অথচ তোমরা তা বুঝতে পারলে না ... আমি কী ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করলাম? মহানবী (সা.) বলেছিলেন এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। আরো বলেছিলেন- তোরা একটি দেওয়ালের গাঁথনি করা ইটের মতো একটু হেলে পড়লে আস্ত দেওয়ালটিই ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। আরো বলেছিলেন, তোমরা পরস্পর একটি হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের মতোই সম্পর্কযুক্ত। একটি আঙুল কাটলে অপরটিতেও বেদনা সঞ্চারিত হয়।

একজন মুসলমান বিপদগ্রস্ত হলে অপরজন বুঝতে, জানতে পারতেন অবশ্যই। কিন্তু আজ! মসজিদের জামাতের সারি দিনে পাঁচবার উপস্থিতি অবশ্যই বাড়ছে, মানুষের মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে তবু কেন পেটের দায়ে কিছু লোককে ভিক্ষা করতে দেখা যায়? পেটের দায়ে নারীদের অনেকে আজ বেশ্যালয়ের পথে পা দিচ্ছেন? আমরা যথাসম্ভব দান করি, মুষ্টিভিক্ষাও নেই আবার ওদের এ দুরবস্থার স্থায়ী উন্নতি বিধানের কোনো চিন্তাই করি না।

বরং উল্টো এ দুরবস্থার জন্য ওদের চারিত্রিক কোনো দুর্বলতার দিককে দায়ী করি। একজন ধনী ব্যক্তি কোনো ভিখারিকে বলেছিলেন- তোদের বিধাতাও তোদের এ দুনিয়ায় ভিখারির ভাগ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, আমি আর তোদের কত দিব? আরেক জনকে বলেছিলেন তোরা শবেবরাতে ধনী হওয়ার দোয়া করতে পার না? আল্লাহর ভান্ডার তো খোলা ও অফুরন্ত থাকে।

সৃষ্টিকর্তা খালিক ও মালিক দয়াবান, মেহেরবান আল্লাহ পাক তাঁর একান্ত ও নিজস্ব বাণীতে বলেছেন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব। তাই সৃষ্টির এক অংশ অন্য অংশের কাছে হাত পাতবে, এতে মানবতা আর ইনছানিয়তেরই অবমাননা, তাই ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তির কোনো স্থানই নেই। প্রকৃতিগত কারণে বিপদগ্রস্ত, পঙ্গু রোগীদের জন্য রেখে দিয়েছেন ধনী বিবেকবান মানবসমাজ যাদের বলে দেওয়া হয়েছে সৃষ্টির সেবা মানেই স্রষ্টার সেবা। কবি এরূপই বলে গেলেন জীবে প্রেম করে যে জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর। ইসলাম, জীবন বিধান আল ইসলাম বিভিন্নভাবে সমাজেরই এসব পক্ষাঘাতিক জনদের দৃষ্টিতে রাখার ব্যবস্থা করেছিল, যা আজ শুধু কথায় ফানুস। চল্লিশ বাড়ির ভেতরে যে কেউ উপোস করলে আর তুমি উদরপূর্তি করে খেলে তুমি কখনও মোমিন হতে পারবে না। (হাদিস)।

রাষ্ট্রীয়ভাবে হুকুমাতে ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠিত বয়তুলমাল জাকাত, উশর প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজে সৃষ্ট উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন মহানবী (সা.)। আজকের মসজিদের প্রতিষ্ঠিত জামাতগুলো তারই অনুপূরক ছিল। সেগুলো আজ শুধু খোলসেই জীবিত। ৩০ পারা কোরআন শরিফের ৬৬৬৬টি আয়াত মানব জীবনকেই সুপথে সাম্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠিত করণেরই এক জীবন্ত ও যুগান্তকারী ব্যবস্থাপত্র ছিল যা আজ দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে সরে গিয়ে লোহা-তামার কবচে দুরারোগ্য শিশু আর রোগীর গলার মালা হয়ে শোভা বর্ধন করছে। জীবিতকে নয়-মৃতের আত্মার সদগতির জন্যই গঠিত হচ্ছে মাত্র।

জীবন বিধান আল কোরআনে নামাজের পরপরই যতবার নামাজের নির্দেশ এসেছে প্রায় ততবারই জাকাতের নির্দেশ রয়েছে। বিশ্বের এ যাবৎ কালের প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক অধ্যয়নে জানাজায় একমাত্র জাকাত বিধানের জন্যই আল কোরআন অন্যান্য সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে আলাদা ও অনন্য মর্যাদার অধিকারী! তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রকার দান-খয়রাত। এতসবের পরও বলতে বাধা নেই, কোনো লজ্জাও নেই, দ্বিধা-সংকোচ যে মুসলিম মিল্লাতেই ভিক্ষুকের এত ছড়াছড়ি। ধর্মগ্রন্থগুলোতে শুধু বিধান থাকলেই চলবে না- প্রথম তো এগুলোকে বুঝতে ভুল হয়, বাকা অর্থ গ্রহণ করা হয় কোথায়ও বা অবজ্ঞাও করা হয়।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে একজন সাহাবী বলেছিলেন- ইসলামকে জানার পথ কী? উত্তরে রাছুলুল্লাহ বলেছিলেন কোরআন পড়। তাতেও যদি না বুঝ, তবে আমি কী বলি তা শোন- তাও যদি না বুঝ, তবে আমি কী করি তা দেখে নাও। আল্লাহর কিতাব খোদার বান্দাহদের যে সব অধিকার প্রদান করেছিল, কোরআনের নামধারী ইসলামের, ছুন্নতের নামে কল্পিত বেশধারী ব্যক্তি সে সব বঞ্চিত-পীড়িত, মজলুম, মাহরুম জনতাদের তা পাইয়ে না দিয়ে ওরা নিজেদের প্রভাব আর অধিকারই ওদের উপর বিস্তার করতে উদ্যোগী।

জাকাত প্রাপকের শ্রেণি বিভাগ আল কোরআনে সংরক্ষিত থাকার পরও ওরা দ্বীনি শিক্ষার নামে এসব জাকাত, সদকা, দান মাদ্রাসায় নিয়ে নেয়া হয়, তদ্রূপ ফিতরা কোরবানির চামড়ার টাকাও পার্শ্ববর্তী এতিমণ্ডমিহাতিনদের দেবার কথা না বলে কোনো কোনো মাদ্রাসার নামে তা নিয়ে যায় আর এমন ভক্তরাও রয়েছেন, যারা হুজুরের কথায় জাকাত, ফিতরার স¤পূর্ণ টাকা ওদেরই হাতে পৌঁছে দেন। এমন অভিযোগ অনেকে করেন; কিন্তু ‘তারা ভেবে দেখেন না যে এসব মাদ্রসা-ইয়াতিম মিসকিনদের দায়িত্ব নিয়েছে।

শিশু থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াচ্ছে। খাওয়া, থাকা, বিদ্যুৎ তাদের জন্য ফ্রি করে দিয়েছে। যে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে মন্তব্য করার আগে আর আলেমরা অবশ্যই নিকটাত্মীয়দের দানের কথা বলে থাকেন। মিল্লাতের সার্বিক দুরবস্থা নুরের চশমা দিয়ে না দেখে বাস্তবতার চোখ দিয়ে দেখলে যে কোনো বিবেকবান বিনা দ্বিধায় যা বলবেন- তা হলো মিল্লাত-হয়তো কোমায় ভুগছে, মহান আল্লাহ আমাদের এ দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করুন।