সংকটে বয়কট, বয়কটে সংকট! বয়কট শুরুর ইতিহাস

রাজু আহমেদ

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইংরেজ ভদ্রলোক চার্লস কানিংহাম বয়কটের কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের বর্গাচাষিসহ স্থানীয় লোকজন তাকে একঘরে করার যে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন সেই রীতি থেকে বয়কট শব্দটি অভিধানভুক্ত হলো। ১৮৮০ সালে চার্লস কানিংহাম বয়কট আয়ারল্যান্ডের খাজনা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন। সে বছর ফসলের ফলন কম হওয়ায় কৃষকরার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল। তখন রাষ্ট্রীয় ফরমানে ১০ শতাংশ খাজনা মওকুফের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের দাবি ছিল ২৫ শতাংশ খাজনা মওকুফ করতে হবে। চাষিদের এ দাবি অস্বীকার করেন লর্ড আর্নে! চার্লস কানিংহাম বয়কট মাতুব্বরি দেখাতে গিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে ১১ জন বর্গাচাষিকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটান। এর প্রতিবাদস্বরূপ বয়কটের গৃহকর্মী থেকে দিনমজুরেরা বয়কটকে বয়কট করে। ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এমনকি স্থানীয় ডাকঘরের পিয়নও বয়কটের কাছে চিঠি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। বয়কটও কম যাননি। তিনি দূর থেকে শ্রমিক এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনরোষ আরো প্রকট হতে থাকে। এই ঘটনা ফলাও করে তৎকালের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং তৎকালীন সেটা ভাইরাল হয়। চার্লস কানিংহাম বয়কটকে এই বয়কট কাণ্ড অভিধানে যুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে! দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে এখানে- ওখানে বয়কট বয়কট ভালো সংকট সৃষ্টি করেছে।

অতীত ও বর্তমানের বয়কট : ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী গণজাগরণে ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দ দাস, প্রাক-গান্ধী যুগের অরবিন্দ ঘোষ, গঙ্গাধর তিলক এবং লালা লাজপত রায় প্রমুখ ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা। ব্রিটিশদের পণ্য ত্যাগ করে স্বদেশী পণ্যের প্রতিনির্ভরতাই ছিল এ আন্দোলনকে সফল করার নেয়ামক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশমাতৃকার প্রতি ভক্তি জাগাতে রচনা করলেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-গীতটি। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন বিতর্কে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের হিরিক লেগেছিল দেশে দেশে। অতিসম্প্রতি ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গাজা আক্রমণের ফলে মুসলিম বিশ্ব থেকে ইসরাইলী পণ্যগুলো বয়কটের ডাক এসেছে এবং অনেকটা সফলও হয়েছে। ক্রেতারা পণ্য পছন্দে সচেতন হয়েছে।

বয়কটের অর্থনৈতিক ক্ষতি : বয়কটের ডাক কেবলই প্রচলিত ট্রেন্ড নাকি অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়? গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও পরিসংখ্যান বলছে, বয়কটে বিরাট ক্ষতি হয়। বিশ্বের এক নম্বর ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডসের প্রধান নির্বাহী ক্রিস কেম্পজিনস্কি চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি হঠাৎ প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি দিলেন যে, গাজায় ইসরাইলের অভিযানের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ও তার বাইরে তাঁর কোম্পানির ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। অনুরূপ ক্ষতির কথা স্বীকার করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কফি চেইন স্টারবাকস (প্রথম আলো, ৩০ মার্চ-২০২৪)। ইসরাইলের যে পণ্য বাংলাদেশের বাজারে কয়েক মাস পূর্বেও ১০০ টাকায় হরদম বিক্রি হতো, সেই পণ্যের মূল্য ৪০ টাকা হ্রাস করে ৬০ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েও মার্কেটে ক্রেতার মন পাচ্ছে না। দেশের বাজারে ফ্রান্স এবং ইসরাইলি পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং বিদেশি বিকল্প কিংবা দেশি পণ্যের ওপর ক্রেতার নির্ভরতা বাড়ছে। শুধু ইসরাইল ও ফ্রান্সের পণ্য নয় বরং ফ্রান্সের ও ইসরাইলের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা একাত্মতা পোষণ করেছে, পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদাও বাজারে ব্যাপকভাবে কমেছে। মূল্য হ্রাস করেও তারা বাজার পাচ্ছে না। বাজার পেতে হলে তো ক্রেতার মন পেতে হবে। ক্রেতার মনে তারা নেই। ক্রেতার মনে ফিলিস্তিনের শহীদ শিশুরা জায়গা নিয়েছে।

তরমুজ, গরুর মাংস এবং অন্যান্য পণ্য বয়কট : দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা দিনে দিনে সিন্ডিকেটের কড়াল গ্রাসে চলে যাচ্ছে। যাতে একদিকে উৎপাদক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, অন্যদিকে ভোক্তাও সামর্থ্যের মধ্যে স্বস্তি নিয়ে বাজার থেকে ফিরতে পারছে না। রমজান মাসে দেশীয় ফল তরমুজের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। অথচ বাজারে তরমুজের মূল্য আকাশচুম্বী। রমজানের শুরুর দিকে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে দেখলাম, তরমুজ উৎপাদনকারী কৃষক জানেই না যে তরমুজ কেজিতে বিক্রি হয়! কৃষকরা খেত থেকে পাইকারদের কাছে পিছ হিসেবে তরমুজ বিক্রি করে।