দ্বার রুদ্ধ করে ভ্রমরকে রুখি

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘দ্বার রুদ্ধ করে আমি ভ্রমরটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’ কবির কথার সঙ্গে মিলিয়ে বলতে গেলে একটি শিশুর শৈশব বন্দি করে তার কাছ থেকে মুক্তমনের মানুষ আশা করা যায় না। শিশুর মন বিকশিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে তাকে একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের বর্তমান শৈশব একটি বন্দি শৈশব। একটি চমৎকার শৈশব ভবিষ্যতের প্রেরণা। এই শৈশব হবে মুক্ত। অথচ আমরা আজ একটি মুক্ত শৈশব উপহার দিতে ব্যর্থ বর্তমান প্রজন্মকে। মাঠের সঙ্গে দুরন্ত এক শৈশবের সম্পর্ক রয়েছে। আজ চোখ বুজলেই সে দুরন্ত শৈশব আমাদের চোখে ভাসে। দুরন্ত শৈশব মানেই জীবনে বিচিত্র সব খেলাধূলার অভিজ্ঞতা অর্জন করা। যাতে বৃদ্ধকালে সেসব দিনের কথা মনে করে সময় অতিবাহিত করা যায়। আজ সেই মাঠ নেই, পুকুর নেই, জোলা নেই। আছে কেবল দালানকোঠা। ঘুড়ি ওড়ানোটা এখনো কিছুটা গ্রামে গঞ্জে দেখা যায়। আমাদের সময় এটি ছিল আনন্দের অন্যতম প্রধান উপকরণ। এখন অবশ্য বছরে এক দিন ঘটা করে ঘুড়ি উৎসব পালন করা হয়।

পরদিন সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ছিল মূলত যখন বাতাস পাওয়া যেত প্রচুর। আমাদের ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য খোলা মাঠ অথবা নদীর তীর দরকার। এই ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড়তম সম্পর্ক বিদ্যমান। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পরিচয় ঘটছে সবুজ ঘাসের সঙ্গে, নদীর তীরের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে, আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের সঙ্গে। অর্থাৎ প্রকৃতির সম্পূর্ণ পাঠটাই যেন এক খেলাতেই শেখা যায়। আমাদের মাঝেমধ্যে এমন হতো যে পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘুড়ি নামানোর পর দেখা যেত তাতে জল ভরে রয়েছে। নাগরিক জীবনের প্রতি ঝুঁকে পরার পাশাপাশি আমরা আমাদের রক্তের সাথে মিশে থাকা অনেক সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হচ্ছি। শুধু আসক্ত হচ্ছি না বরং নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সেগুলোকেই আঁকড়ে ধরছি। যেন তাদের সংস্কৃতিতেই বেজায় আনন্দ। আমাদের খেলাধুলা, সংস্কৃতি যেন মূল্যহীন। যদিও ওসব আমাদের ধাঁচে কখনো ছিল না তারপরেও যেহেতু আধুনিকতার নামধারী স্রোতে আমাদের গা না ভাসালে চলে না তাই নিজেদেও অনেক কিছু না ভুললেও চলে না!

আজ রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা করতে গিয়ে বড় বড় সব ব্যানার চোখে পরে। সেসব বিল্ডিংয়ের ভেতর নাকি নামিদামি সব স্কুল-কলেজ। সেসব প্রতিষ্ঠানের চাহিদাও বহুগুণ। ভালো রেজাল্ট হয়। তবে ভালো মনের খবর কেউ রাখে না। মনটাকে বন্দি রেখে যে কিছুই আদতে সম্ভব নয়, সেটিই আমরা ভুলে গেছি। অথচ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম শর্তই হলো একটি মাঠ। যেখানে ছেলেমেয়েরা হৈ-চৈ করবে, কারণে-অকারণে ছোটুছুটি করবে। কিন্তু আজ কতগুলো স্কুলে এমন দৃশ্য দেখা যায়। গ্রামে গঞ্জে দেখা গেলেও শহরে তেমন দেখা যায় না। আর গ্রামগুলোও শহরের আদলে নিজেদের বদলে ফেলছে ফলে গ্রাম থেকেও সে দৃশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। স্কুল থেকে ফিরে এখন যেমন সন্তান মোবাইল ফোন বা ট্যাব নিয়ে গেম খেলতে বসে যায়। আগে কিন্তু এমন ছিল না। আগে স্কুল থেকে ফিরে চলে যেত মাঠে। মাঠও ছিল বাড়ির পাশে। প্রতিটি এলাকায় দেখা যেত খোলা জায়গা আছে ছেলেমেয়েদের খেলার জন্য। তাই সে খোলা স্থানের অভাব ছিল না সে সময়। আজ আর সেরকম নেই। তাই বাধ্য হয়েই হয়তো মোবাইল ফোনে মানসিক প্রশান্তির খোঁজ করে। আগে যে আমরা যে সবাই সারাদিন শুধুই খেলতাম বিষয়টি এমন না। তবে দুপুরের পর আমরা ১০-১২ জন একত্রিত হতাম। মানে মাঠে চলে যেতাম। তারপর যেকোনো একজন কোনো একটা খেলার নাম প্রস্তাব করত। এক খেলাতেই যে সারা বিকাল শেষ করতাম তা কিন্তু না। বরং একদিনে তিন চার রকম খেলা খেলতাম। যেমন- প্রথমে বউ চুরি খেলা শুরু করলে সেটি বার দুই খেলার পর বদন বা অন্য খেলা খেলতাম। সব থেকে বড় কথা হলো- আমরা অনেকটা বড় হয়েও ছেলেমেয়েতে একসঙ্গে খেলতাম। এখন যা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আমাদের মনে কোনো নেতিবাচক চিন্তা কোনোদিনও আসেনি। আবার আমাদের পাড়ার অভিভাবকরা বিষয়টি সহজভাবেই দেখেছে। গর্ব করে একটা কথা বলতে পারি আমাদের গ্রামে যখন আমরা ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা শুরু করলাম তখন; কিন্তু দুচারজন মেয়েও আমাদের সঙ্গে খেলতে আসত। আজকাল দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে, আমরা সভ্য হয়েছি তাই মনমানসিকতাকে আরো নেতিবাচক করে ফেলেছি।

বাংলাদেশের সব শহরেই মাঠের তীব্র সংকট রয়েছে। প্রথমেই রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। সম্প্রতি এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেই নিবন্ধে জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় সবার জন্য প্রবেশাধিকার আছে এমন মাঠ আছে মাত্র ৪২টি। ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার মাঠের পরিষেবার মধ্যে বসবাস করেন। বাকি ৮৪ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ঢাকা মহানগরীর খেলার মাঠ-পার্ক-গণপরিসর সুবিধাদির এলাকাভিত্তিক সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে টেকসই পরিকল্পনা শীর্ষক এক নিবন্ধে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি), সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম বাংলাদেশ। জানা যায়, ঢাকা শহরে খেলার মাঠ আছে মোট ২৩৫টি। তার মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ রয়েছে, যেখানে সবার প্রবেশাধিকার নেই। সবার প্রবেশাধিকার আছে মাত্র ৪২টি মাঠে। আরো ৫২টি মাঠ রয়েছে, যেগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক; কিন্তু সবার প্রবেশাধিকার নেই; যেমন ঈদগাহ ও কলোনির মাঠ। নিবন্ধে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। এর মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ড আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ড রয়েছে। আইপিডির সম্প্রতি এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে নিবন্ধে বলা হয়েছে, নগর পরিকল্পনার মানদ- অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে ৭৯৫টি, চট্টগ্রামে ৫৪১টি, রাজশাহীতে ৩৭টি, খুলনায় ৬৫টি, সিলেটে ৪০টি ও বরিশালে ৪৫টি খেলার মাঠের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে এসব নগর এলাকার অধিকাংশ শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে স্বাভাবিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের বিদ্যমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১০) অনুসারে, প্রতি সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ দরকার, যার প্রতিটির আয়তন হবে ন্যূনতম এক একর। এই যে শিশু-কিশোরদের মাঠগুলো আমরা ধ্বংস করছি তার খেসারত দিচ্ছে এই প্রজন্ম।

মাঠ শিশু কিশোরদের বিনোদনের একটি বড় অনুষঙ্গ। খোলা মাঠে যাদের শৈশব কেটেছে কেবল তারাই জানে একটি মাঠ শিশু মনে ঠিক কী পরিমাণ আনন্দ বয়ে আনতে পারে। আজকের শহরে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েরা জানেই না খোলা মাঠে দৌড়ানোর মজাটা কী। মাঠ মানেই খোলা আকাশের সাথে পরিচিত হওয়া। মাঠ মানেই অনেক শিশু-কিশোরের সঙ্গে মেলামেশা। বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির পাঠও যে খুব দরকার আমাদের। যা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর মনোজগত বিস্তৃত করতে সাহায্য করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাই একটি মাঠ শিশুদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেভাবে শহরায়ন প্রক্রিয়া বিকশিত হচ্ছে, তাতে ধারণা করা যায়, হয়তো শিগগির মাঠগুলো হয়তো একদিন শহরের যাঁতাকলে হারিয়ে যাবে। তাই শিশুদের খেলাধূলা করার মাঠগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে অন্তত একটি খোলা জায়গা থাকে. যেখানে টিফিনের সময় একটু সময় ছোটাছুটি করতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। এটা কিন্তু শিক্ষারই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশুদের একটি আনন্দমাখা শৈশব উপহার দেওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে।