যানজটে হারাচ্ছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব

প্রতিদিন নষ্ট হওয়া কর্মঘণ্টার মূল্য ১৪০ কোটি টাকা

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যানজটের কারণে ঢাকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি উন্নয়নে কার্যত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যানজট পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। বিদ্যমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার, পার্কিং সুবিধা নিশ্চিত করা, ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদার মুক্ত করা, ওয়ান-ওয়ের পাশাপাশি আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু, সুনিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যপরিবহন নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি গৃহীত উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা একান্ত অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর ঢাকার যানজটের কারণে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রায় ২.৯ শতাংশ হ্রাস পায় এবং প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া কর্মঘণ্টার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি, অবৈধ ফুটপাত দখল, অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং, অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো ও অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে বিশেষ করে পুরান ঢাকায় সৃষ্ট অসহনীয় যানজট পরিস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম চালু, নদীপথের ব্যবহার বাড়ানো এবং পুরান ঢাকার প্রধান সরু ও ব্যস্ত সড়কে একমুখী ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ঢাকা শহরে ব্যবহারযোগ্য রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে রাস্তার ওপর গণমানুষ ও পরিবহনের চাপ অত্যাধিক। চকবাজার, মৌলভীবাজার, ছোটকাটরা ও বড়কাটরা, পাটুয়াটুলীসহ অন্যান্য এলাকায় যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া এই এলাকায় পাইকারি বাজারগুলোতে পার্কিং সুবিধা না থাকার যানজট লেগে থাকে। গুলিস্তানে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া গেলে যানজট আরো কমবে। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সাথে ১৮টি স্টেকহোল্ডার রয়েছে। সবার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে যানজট কমনো সম্ভব হবে।

পুরান ঢাকার যানজট নিরসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অংশগ্রহণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও ওই এলাকায় গাড়ি পার্কিং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহন ব্যবস্থার বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। রাজধানীতে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলে বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়। ফলে যাত্রীরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত সেই শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ৮ শতাংশ রাস্তা দিয়েও ঢাকার যানজট নিরসন করা সম্ভব। তারা মনে করেন, দক্ষ লোকবল দিয়ে যোগাযোগ খাত পরিচালনা না করাসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার যানজটের এ করুণ অবস্থা। ঢাকার যানজটের এ চিত্র সারা বছরের। তবে তা আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে যখন কোনো উৎসব-পার্বণ দেখা যায়। আর কয়েকদিন পরই ঈদুল ফিতর। আর এখন রাজধানীর প্রতিটি সড়ক ও মোড়ে যানজটও বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব গাড়ি সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখলে রাখছে। দক্ষ লোকবল দিয়ে যোগাযোগ খাত পরিচালনা না করাসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার যানজটের এ করুণ অবস্থা। যে হারে যানজট বাড়ছে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। যানজটে আরও স্থবির হয়ে পড়বে পুরো ঢাকা শহর। দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়। মেট্রোরেল চালুর পর সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন মিরপুর এবং উত্তরার বাসিন্দারা। আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হতো, এখন সেই পথ খুব সহজে ও অল্প সময়ে পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। আধা ঘণ্টারও কম সময়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে পারছে মানুষ। তবে উল্টো চিত্র রাজধানীর অন্য সড়কগুলোতে। সেসব সড়কে যানজটে নাকাল নগরবাসীকে এখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে কাটাতে হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশে। অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে এ ক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে নগরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়, যা এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২৫ বছর আগেও ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিবেগ ছিল ২৫ কিলোমিটার, এখন সেটা কমতে কমতে ৩-৪ কিলোমিটারে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। ১৫২টি দেশের এক হাজার ২০০টির বেশি শহরের যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে এ চিত্র তুলে আনা হয়েছে। যান চলাচলে এ ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা দেশের অর্থনীতিতেও। যানজটের কারণে প্রতিদিন ঢাকার মানুষের ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। জ্যামে বসে থেকে পরিবহনের অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ জ্বালানি খরচ হচ্ছে। গাড়ি রাস্তায় জ্যামে আটকা থাকার সময় কার্বনডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশ দূষিত করছে। ফলে অনেক মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে ভুগছে। শুধু এ কারণেই প্রতিদিন ঢাকার মানুষকে অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করতে হচ্ছে। যার দৈনিক মোট মূল্য ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা। এছাড়া যানজটে দীর্ঘ সময় গাড়ি আটকে থাকার কারণে সড়কের আয়ুষ্কাল ১৮-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। গবেষণার তথ্য মতে, ঢাকায় দুর্ঘটনার শিকার ৬০ শতাংশই পথচারী। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা বছরে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৭ সালেও এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। মেট্রোরেল পুরোপুরি চালুর ফলে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করছে। সে হিসাবে আরো ৮৮ শতাংশ যাত্রী রয়ে গেছে। তাদের নিয়ে এখন চিন্তা করা দরকার। এখনই ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। গণপরিবহনের গুণগত মান ভালো এবং চাহিদার বিপরীতে জোগান নিশ্চিত করা গেলে ৫৫ শতাংশ মানুষ তাতে চড়বে।