ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নিজ এলাকায় এমপিদের চিকিৎসা

স্বাস্থ্যসেবায় ফিরিয়ে আনতে হবে আস্থা
নিজ এলাকায় এমপিদের চিকিৎসা

জাতীয় সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকায় চিকিৎসা নিলে স্বাস্থ্যসেবায় সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। গত বুধবার জাতীয় সংসদে এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চোখ দেখাতে যান জাতীয় চক্ষু ও বিজ্ঞান ইনস্টিটিটিউটে। আর সংসদ সদস্যরা যদি নিজ এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, তাহলে সাধারণ মানুষ দেশের স্বাস্থ্যসেবায় আস্থা ফিরে পাবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ভূটানের রাজা এবং নেপালের অ্যাম্বাসেডর আমাকে অনুরোধ করেছেন, ভূটান, নেপাল এবং মালদ্বীপের চিকিৎসাব্যবস্থায় বাংলাদেশ যেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান। আর সেখানে এমপি-মিনিস্টাররা বাংলাদেশে চিকিৎসা করাবেন, সেটাও ভাবতেও অবাক লাগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা সে কারণে তিনি ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কিনে সাধারণ রোগীর মতো চোখ দেখান। আমাদের দেশের মানুষের বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। তার মধ্যে রয়েছে- বিদেশে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা, উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধা, দ্রুত রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা এবং চিকিৎসকরা আন্তরিক ব্যবহার। এছাড়া পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেন বিদেশি চিকিৎসকরা। আমাদের দেশের চিকিৎসকরা কীভাবে রোগী দেখেন এবং তিনি দিনে-রাতে কতটা সময় রোগী দেখেন, তার কোনো সময়সীমা নেই। পরীক্ষা- নিরীক্ষার নামে রোগীর পকেট কাটার অভিযোগও রয়েছে আমাদের দেশের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। বিদেশের তালিকায়- প্রথমত পড়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশও রয়েছে- অতি ধনীদের পছন্দের তালিকায়। বিদেশগামী বাংলাদেশি রোগীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।

উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি এর কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যোগাযোগ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় যেতে যত সময় লাগে, ভারতে যেতে তার চেয়ে কম সময় লাগে। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের খাবার-দাবার, ভাষা এবং সংস্কৃতির রয়েছে অনেক মিল। প্রতি বছর বাংলাদেশি রোগীদের ভারতমুখী স্রোত বেড়েই চলেছে। এর কারণ দেশের চিকিৎসা সেবায় জনগণের আস্থাহীনতা, অরাজক অবস্থা, নিম্নমানের সেবা ও উচ্চ খরচ। বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে যান জটিল হার্ট সার্জারি, ক্যান্সারের চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা, অস্থি ও অস্থিসন্ধির অপারেশন, স্নায়ুরোগ, কিডনি রোগ, মেডিক্যাল চেকআপ করার জন্য। স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত পিছিয়ে। মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসের লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হয়নি ভারত। অথচ সেই দেশটি দিনে দিনে চিকিৎসা পর্যটনের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে! কোনো একটি দেশ নিজেকে চিকিৎসা পর্যটনের গন্তব্যে পরিণত করতে চাইলে প্রথম শর্ত হলো- দেশটিকে সুলভ মূল্যে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ভারত সেই কাজটি করতে পেরেছে। শুধু বাংলাদেশি রোগী নয়, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। ভারত সরকার অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করে। এর আওতায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও করপোরেট বিনিয়োগে ভারতে দ্রুত বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠতে শুরু করে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে জমি ও কর সুবিধা নিয়ে ভারতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলে লাভজনক দৃষ্টিনন্দন অজস্র হাসপাতাল। চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে ভারতে করের পরিমাণ মাত্র ১২ শতাংশ অথচ বাংলাদেশে এই করের হার ৪৫ শতাংশ)। একই পণ্য আমদানি বা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মাত্র একবার ভ্যাট দিতে হয়। বাংলাদেশের মতো বার বার ভ্যাট দিতে হয় না। ভারতের হাসপাতালগুলো বহু ক্ষেত্রেই নিজস্ব প্রযুক্তি, নিজস্ব উৎপাদিত চিকিৎসাসামগ্রী ব্যবহার করে থাকে। উন্নত ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিপুলসংখ্যক রোগীকে তারা আকৃষ্ট করে একই অবকাঠামো ব্যবহার করে। তারা বিপুলসংখ্যক পরীক্ষা, সেবা, যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে চিকিৎসা সামগ্রীর পুনর্ব্যবহার ও জনশক্তি সাশ্রয় করে। যার ফলে তারা সুলভ মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে সমর্থ হয়। ভারতের অর্থনীতিতে চিকিৎসা পর্যটনকে রপ্তানি পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয় এবং রপ্তানি খাতের আয় হিসেবে সব আর্থিক সুবিধা পায়।

ভালো ব্যবহার ভারতীয় চিকিৎসকদের নিছক ভালোমানুষী বা মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি তাদের করপোরেট সংস্কৃতির বাধ্যবাধকতা। ভারতের চিকিৎসকদের জবাবদিহি করতে হয়। চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া রোগীবান্ধব অবস্থানে থাকে। যা চিকিৎসকদের ভুল করা থেকে সতর্ক থাকতে ও চিকিৎসায় প্রমাণভিত্তিক অনুশীলনে বাধ্য করে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা দু’একবার ভারতের করপোরেট হাসপাতাল ঘুরে এসে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ভারতের সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ওখানেও প্রচুর অব্যবস্থাপনা, ভুল চিকিৎসা, হাসপাতালের মেঝেতে রোগী শুয়ে থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করে। ভারতের করপোরেট চিকিৎসা পর্যটনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ আর অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী হওয়ার জয়গান করছে। আমাদের দেশের ডাক্তাররা রোগীদের সময় দেন না। অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করেন। অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করান, পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল আসে, একই টেস্টর রিপোর্ট একেক ডায়াগনস্টিকে একেক রকম আসে, ডায়াগনস্টিকে পরীক্ষা না করে রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ। চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে অতিরিক্ত ওষুধ লেখেন। তারা ওষুধ কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে কমিশন পান। ক্লিনিকে অপ্রয়োজনীয় সার্জারি, সার্জারির নামে প্রতারণা, রোগীদের কাছ থেকে যেনতেন প্রকারে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর থাকে ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু। চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের বাদানুবাদ হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসকদের শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। আমাদের সার্বিক চিকিৎসাসেবা পার্শ্ববর্তী দেশের করপোরেট হাসপাতালগুলোর চেয়ে এখনও অনুন্নত, দুর্দশাগ্রস্ত ও অপ্রতুল। আমাদের চিকিৎসাসেবায় উচ্চ ব্যয় কমাতে না পারলে ও সেবার মান উন্নত করতে না পারলে দেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যাবে না এবং সুস্থ বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতও গড়ে উঠবে না।

অতএব, নীতিনির্ধারক ও জনগণের অগ্রগামী অংশকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক দোষারোপ বা আত্মপক্ষ সমর্থনে সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের দুর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সঠিক নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে গড়ে তুলতে হবে- শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য যথাযথ বিনিয়োগ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত