মহিমান্বিত শবেকদর

তাৎপর্য ও ঐতিহাসিকতা এক অনন্য রাত

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ পবিত্র শবেকদরের রাত। মহিমান্বিত শবেকদর মুসলিম উম্মাহর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অগণিত রহমত ও বরকতের নিদর্শন। অধিকাংশ মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদের মতে, পবিত্র মাহে রমজানের ২৭তম রাত তথা ২৬ তারিখ দিবাগত রাতই শবেকদর। সারা বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী হিসেবে গোটা মুসলিম মিল্লাতের কাছে এই পবিত্র ও বরকতময় রাতের অতীব মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। অসংখ্য গোনাহগার এই রাতে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। ইবাদতকারীর সৌভাগ্যের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়, মহান স্রষ্টার পক্ষ হতে শান্তি ও রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয়। অগণিত পুণ্য লাভে বান্দা স্বীয় জীবনকে ধন্য করার সুযোগ পায়। ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং সকল স্থানে তারা ছড়িয়ে পড়েন। বান্দাহর তওবা, অনুশোচনা, কান্না, ফরিয়াদ ও প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয় এই রাতে। পরম স্রষ্টা তাঁর সৃষ্ট মানবাত্মার পানে করুণার দৃষ্টিতে তাকান। পূর্ব দিগন্তে সূর্যালো প্রতিভাত হওয়া পর্যন্ত এ পবিত্র রাতকে মহান আল্লাহ মানুষ ও মানবতার জন্য বরকতে পরিপূর্ণ এবং শান্তিময় করে রাখেন। শবেকদরের গুরুত্ব, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বলতে এমনটাই। ইমাম মালিক (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, রাসূল (সা.)-কে এই মর্মে অবহিত করা হয় যে, তাঁর উম্মতের জীবনকাল সীমিত, সংক্ষিপ্ত। স্বল্পায়ুপ্রাপ্ত হবে উম্মতে মোহাম্মদি- এ ধরনের খবরে সাহাবিদের কেউ কেউ ভাবলেন, যদি আমাদের আয়ুষ্কাল কম হয়, তাহলে পুণ্যার্জনের দিক থেকে পূর্বেকার মানুষদের চাইতে আমরা পিছিয়ে পড়ব। অনেকদিন পৃথিবীতে বাঁচার কারণে আগেকার মানুষরা অধিক পুণ্য হাসিল করে উচ্চতর মাকাম তথা উন্নত মর্যাদার স্তরে উপনীত হবে আর আমরা সে অবস্থানে উন্নীত হতে পারব না। নবীজির কাছে সাহাবায়ে কেরামের এ ধরনের ভাবনার খবর প্রকাশ পেয়ে যায়। সাহাবিদের যৌক্তিক ভাবনার সঙ্গে নবীজির মমত্বপূর্ণ অন্তঃকরণ সায় দেয়। করুণাময় প্রভু তাঁর দয়া-মমতার ভাণ্ডার হতে উম্মতে মোহাম্মদির মর্যাদাগত অবস্থানকে অপরাপর সকল জাতিগোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে রাখার মহান লক্ষ্যে দান করেন এই সর্বশ্রেষ্ঠ রজনী শবেকদর।

কোরআনুল কারিমে স্বতন্ত্র একটি সুরার নামকরণ করা হয় ‘কাদ্র’ হিসেবে; যেখানে মহান আল্লাহপাক এই রাতের মর্যাদা, গুরুত্ব ও অবস্থান তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘আমি এই মহাগ্রন্থকে (আল-কোরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। হে নবী (সা.)! আপনি কি জানেন এই শবেকদর কি? শবেকদর হচ্ছে হাজার মাসের চাইতেও উত্তম রাত্রি। হজরত জিব্রাইলসহ এ রাতে ফেরেশতারা দুনিয়াতে অবতরণ করেন। পরম স্রষ্টার সদয় অনুমতিক্রমে তাঁরা প্রতিটি কর্ম সম্পাদন করেন। প্রভাতের আলোকরশ্মি উদিত হওয়া পর্যন্ত সে রাত শান্তিময়-নিরাপদ থাকে।’ মহান প্রভুর উপরোল্লিখিত বাণীতে শবেকদরের প্রকৃত মাহাত্ম্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। প্রথমত, পৃথিবীর একমাত্র নির্ভুল মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এ রাতেই অবতীর্ণ করা হয়েছে। সুতরাং কোরআন নাজিলের মহিমান্বিত রাত যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত হবে, তাতে আর কোনো দ্বিধা নেই। প্রিয়তম নবীকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, আপনি আপনার উম্মতের স্বল্পায়ু নিয়ে কোনোরূপ দুশ্চিন্তায় থাকবেন না; কারণ আপনার উম্মতের জন্য এই একটি রাতই হাজার মাসের চাইতেও শ্রেষ্ঠ। তার মানে হলো, আপনার অনুসারী কোনো ব্যক্তি একটি শবেকদরে ইবাদত করলেও সে অন্যদের তুলনায় অন্তত ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের সমান বা তার চাইতেও বেশি সওয়াব লাভ করবে। পূর্বেকার মানুষেরা দীর্ঘ হায়াত পেয়েও যা অর্জনে সক্ষম হয়নি। এ রাতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লাহপাক বলেন, ফেরেশতাদের সর্দার জিব্রাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে অসংখ্য ফেরেশতা এ ধরাপৃষ্ঠে অবতরণ করেন এবং মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা সকলেই ইবাদতকারীদের সার্বিক কল্যাণে নিজ নিজ কর্মণ্ডসম্পাদনে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। সারাটি রাত যেন এক প্রশান্তির নাম আর সেটি অব্যাহত থাকে ফজর পর্যন্ত।

মূলত হাজার মাসের চাইতেও শ্রেষ্ঠ রজনী শবেকদের কারণেই অন্য মাসসমূহের উপর রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্ব আর বছরের অন্যান্য রাতের উপর শবেকদরের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। কেন না, এ রাত্রেই বিশ্বমানবতার জন্যে পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধান সম্বলিত ঐশী পবিত্র গ্রন্থ কোরআনুল কারিমের আবির্ভাব ঘটেছে। আর শবেকদর যে মাহে রমজানেরই কোনো একটি রাত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এ রাতের সুনির্দিষ্টতা নিয়ে এখতেলাফ রয়েছে। এমনকি শবেকদরের বিষয়ে এই মতবিরোধ সাহাবায়ে কেরামের সময়কাল থেকেই চলমান রয়েছে। ধর্মবেত্তাদের কাছে এ বিষয়ে প্রায় ৪০টির মতো মত রয়েছে। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বক্তব্য হলো, রমজানের শেষ ১০ দিনেই রয়েছে শবেকদর। আরেকটু অগ্রগামী মত হলো, শেষ ১০ দিনের কোনো এক বেজোড় রাত্রে শবেকদরের অবস্থান। ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৮তম রজনীতে শবেকদরের সন্ধান করতে ধর্মতত্ত্ববিদরা তাগিদ দিয়েছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত তা সাতাশ রমজানের ক্ষেত্রে তাঁদের সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক বিজ্ঞ সাহাবি, তাবেই, তাবে-তাবেইন, ইমাম, ফকিহ, ইসলামি চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও আলেমের ঐকমত্য রয়েছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও একনিষ্ঠতার স,ঙ্গে শবেকদরে ইবাদত করবে, তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। শবেকদরের ইবাদতের মধ্যে রয়েছে নামাজ, জিকির-আজকার, তেলাওয়াত, রাত্রি-জাগরণ, তওবা-এস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-প্রার্থনা, দুরুদণ্ডসালাম, ক্রন্দন-অনুতাপ, সত্যনিষ্ঠতার প্রতিজ্ঞা, কবর জিয়ারত, আপনজনদের খেদমত, মা-বাবার কল্যাণ কামনা, সব মুসলিমের জন্য প্রার্থনা, দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনা এবং বিশ্বমানবতার জন্য নিরাপদ ও স্বস্তিময় পরিবেশ চাওয়া ইত্যাদি।