সম্প্রীতির বীজ বপনই হোক ঈদের আহ্বান

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধন সুদৃঢ় করতে প্রবাহমান মহাকালের রথের চক্রে আবর্তিত হয়ে বছর পরিক্রমায় মুসলিম জাহানের দুয়ারে আবারও ফিরে এসেছে সেই ‘ঈদুল ফিতর’। সংযমই সকল সৌন্দর্যের মূল। রঙের পাত্র উপুড় করে ক্যানভাসে বা কাগজে ঢেলে দিলে সুন্দর কিছু সৃষ্টি হয় না। অথচ শিল্পীর তুলিতে সেই রঙের সংযত সুষম ব্যবহার কতই না সুন্দর। মাসব্যাপী রমজান মাসের রোজার মহাসমাপ্তিতে ঈদুল ফিতর মহাশিল্পী আল্লাহর দেওয়া এক সৌভাগ্যময় সৌন্দর্যের প্রতীক। সে যাই হোক, সুদীর্ঘ রমজানের ৩০ দিনের রোজা পালন, রেকর্ড লম্বা দিনে ধানখেতে হাল চাষ প্রচণ্ড সূর্যতাপের দিন যাপন এবং শেষে ইফতারের বেলায় প্রচণ্ড লোডশেডিং-সবকিছুরই অবসান ঘটিয়ে শাওয়ালের একফালি বাঁকা চাঁদ গগনে উঁকি মারতেই বিশ্ব মুসলিম আজ আনন্দে আত্মহারা। ঈদ এসেছে মুক্ত বনে উড়ন্ত বিহঙ্গের কণ্ঠে, কবির কলমে, ঝিল্লি পোকার কাকলীতে, আকাশে-বাতাসে। ঈদ এসেছে ছোট্ট সোনামণিদের উজ্জ্বল একগাল হাসিতে ভরা মুখের বুলিতে, বৃদ্ধের শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রীমন্ডি দাঁতের মিষ্টি হাসিতে। ঈদ এসেছে হাতে মেহেদি-মাখানো লাল টুকটুকে শাড়ি আর কানে দুল পরা কিশোরীর স্বপ্নিল দুটি কালো চোখের তারায় ঝিলিক মেরে। ঈদ এসেছে বুকভরা আশা নিয়ে হালচাষরত কৃষকের গুনগুন সুর আর সেই সঙ্গে হেঁই হেঁই উচ্চকণ্ঠে। দিগন্তপ্রসারী সবুজ কঁচিপাতায় নদীর তীরে ঝরা ফুলে আর লাউমাচার উপর দিয়ে দখিনা হাওয়ার হিল্লোলিত সোঁদা-সোঁদা গন্ধ নিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া দিনমজুরের অপ্রশস্ত আঙিনায় ঈদ এসেছে। ছোট্ট খুকুমণিরা আজ নতুন জামা পরে সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন করছে, মোবারকবাদ, খুশি-আনন্দ বিনিময় করছে। ‘ঈদুল ফিতর’ সত্যিই তুমি অপূর্ব। তোমার তুলনা হয় না। ছোট্ট সোনামণি থেকে শুরু করে অশান্ত, অস্থির এই ধরণীর আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে একমাত্র তুমিই হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়েছ। তোমাকে শুধু শুধু পালন করছি ঠিকই, কিন্তু স্বাগত জানানোর ভাষা নেই আমাদের। শুধুমাত্র এটুকুই আল্লাহর কাছে বলতে পারি ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আ-লামিন।’ সম্প্রীতি, ভালোবাসা আর বাঁধভাঙার অকাল স্রোতে ভেসে যাওয়ার বিজয় উৎসব একমাত্র ‘ঈদ’। মানব চরিত্রের মন্দপ্রবণতাকে আরব সাগরের বুকে আঁচড়ে ফেলে সৌভ্রাতৃত্বের রজ্জু দৃঢ় করতে ঈদ আজ নিয়ে এসেছে এক অনাবিল হাস্যরসের চমৎকৃত আনন্দ। বাস্তবিকভাবে বলা যায়, ঈদ মানেই তো হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যাওয়া, সবুজ ঘাসের হাওয়ায় আনন্দ উৎসবের বেলা, ধনী-গরিবের মিলনমেলা, খুশির চেতনায় কাব্যিক খেলা, ফতুর-ধনীব দূরত্ব ছিন্ন করা, ঈদগাহের আঙিনায় সম্প্রীতির মৌচাক বাঁধা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈদের পবিত্র দিনে আজ শহরে-নগরে-বন্দরে, হাটে-ঘাটে, মাঠে, গ্রামের অলি-গলিতে সর্বত্রই খুশির হাওয়া। সামাজিক নিয়মে আজ সকলের ঘরে-ঘরে সুস্বাদু খাবার, পরস্পর-পরস্পরের সঙ্গে প্রীতির মেলবন্ধন। এতসবের পরও ঈদের আনন্দে আমাদের অন্তরে পীড়া দেবে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। আফগানিস্তান সিরিয়ায় অবাধে গণহত্যা, দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, খুন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও ম্লান করে দেবে, তা বলাবাহুল্য। এসব দেশব্যাপী ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই আমাদের। ঈদরে আনন্দ থেকে বঞ্চিত মানুষদের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই সমবেদনা, ঈদগাহ ময়দানে কামনা করব ওদের মাগফিরাত।

ঈদুল ফিতরে প্রচলিত ফিতরা ব্যবস্থা ইসলামের অনবদ্য বিধান। সবাই যাতে ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে তার জন্য বিত্তশালীদের উপর ফিতরার হুকুম স্বয়ং আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন। তোমার সম্পদ রয়েছে বলে উদরপূর্তি করবে আর তোমারই প্রতিবেশী তোমার দিকে চেয়ে আফসোস করবে- তা হতে পারে না। তোমার সন্তান জাঁকজমকে সুসজ্জিত হবে আর শতচ্ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত সন্তান তোমাদের দিকে চেয়ে থাকবে- তা বিবেচনা করেই আল্লাহতায়ালা বিত্তবানদের এসব অধিকার দেননি। তাইতো পবিত্র কোরআনের কড়া নির্দেশ- ‘যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে উদরপূর্তি করে সে মুসলমান নয়।’ আমরা তথা বিশ্বমুসলমানরা হযরত আদম (আ:)-এর বংশধর, সেহেতু মুসলমান হিসেবে এই দিনে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্যদিকে ঈদের আগমনী বার্তা রোজা হচ্ছে- আত্মিক শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের সোপান যার মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর নৈকট্য লাভে সমর্থ হয়। মানুষের চারিত্রিক মন্দ প্রবণতাকে বিতাড়িত করে প্রবৃত্তির লড়াইয়ে বিজয়লাভ করে যে চরিত্রের দৃঢ়তা ও বিশুদ্ধতায় পৌঁছতে পারে তাঁর পক্ষেই সম্ভব পার্থিব জীবনের এই অসাধারণ সাফল্যকে উপভোগ করা। স্থূলতা বিবর্জিত মুসলমানদের পবিত্রতম এই উৎসবটি হচ্ছে ধৈর্য এবং শুকরিয়া জ্ঞাপনের এব অপূর্ব সমন্বয়। আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ঈদুল-ফিতরের তাৎপর্য অপরিহার্য। ঈদুল-ফিতরের রাতকে ফেরেশতারা ‘লাইলাতুল জায়েজা’ অর্থাৎ পুরস্কারের রাত হিসেবে ঘোষণা করেন। পবিত্র হাদিসে বর্ণিত আছে ঈদুল-ফিতরের রাতে মহান আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাগণকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। তারপর যখন সকাল হয় তখন ফেরেশতারা পৃথিবীতে নেমে সকল অলি-গলির মাথায় দাঁড়িয়ে যান এবং মানুষ ও জিন জাতি ছাড়া বাকি সব সৃষ্টির অবগত ভাষায় আহ্বান করে বলতে থাকেন- ‘হে মুহাম্মদের (সা.) উম্মতরা! তোমরা এখন সে রাব্বে করীমের দরবারের দিকে অগ্রসর হও, যিনি পরম দাতা ও অসীম মার্জনাকারী।’ অতঃপর যখন রোজাদার মোমিনরা ঈদগাহের দিকে অগ্রসর হয় মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী বিনিময় হতে পারে সে মজুরের, যে নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন।’ তখন ফেরেশতারা বলেন, ‘হে আমাদের মা’বুদ, দায়িত্ব পালনের বিনিময় হল তার মূল্য পরিপূর্ণভাবে পরিশোধন করা।’ মহান আল্লাহতায়ালা তখন বলেন, ‘হে ফেরেশতাগণ, আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাদের রমজানের রোজা এবং তারাবিহ নামাজের বদলে আমার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা দান করে দিলাম। আর হে আমার বান্দাহরা, তোমরা আমার কাছে চাও, আমার সম্মানের কসম, আমার মর্যাদার কসম, আজকের দিনের এই সমাবেশে (ঈদের) আখেরাত সম্পর্কে যা চাইবে তোমাদের দান করব। তবে দুনিয়া সম্পর্কে যা চাইবে, সে ব্যাপারে তোমাদের হিতাহিতের দিকে নজর রাখব।’ তিনি আরো বলেন, ‘হে আমার বান্দাহগণ, আমার মর্যাদার কসম আপরাধীদের বা কাফের-মুশরেকদের সামনে আমি তোমাদের লাঞ্ছিত করবে না। সুতরাং তোমরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে যে যার ঘরে ফিরে যাও। তোমরা (বান্দাহরা) আমাকে সন্তুষ্ট করেছ, আমিও তোমাদের প্রতি সন্তষ্ট হয়েছি।’ তখন আল্লাহর ফেরেশতাগণ ঈদের দিন উম্মতের প্রতি মহান আল্লাহর এই দয়া-দান দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। অতঃপর মুসলমানরা ঈদগাহে রওয়ানা হয়ে খোলা আকাশের নিচে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে জামাতের সঙ্গে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করেন। এই নামাজ আদায়ের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অনেক হলেও ব্যবধান বেশি নয় সামজিক বিষয়েও। কারণ ঈদের আধ্যাত্মিকতার সব কর্মসূচিই সামাজিকভাবে পরিলক্ষিত। পবিত্র রমজান মাসে নিজের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, সমবেতভাবে ঈদের ময়দানে নামাজের মাধ্যমে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। নামাজ শেষে সবাই ছুটে চলে বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনের খোঁজখবর নিতে। সকলের ঘরে ঈদের আনন্দ ও খুশিতে চলে পিঠাণ্ডপুলি, সন্দেশ, মিষ্টি বিতরণ, অতিথি আপ্যায়ন, একে অপরকে আলিঙ্গন ও শুভেচ্ছা বিনিময়। ঈদের দিনের আনন্দে মাতোয়ারা হয় গোটা বিশ্ব। সারা বছরের উচ্ছ্বাসের ঢেউ এদিনই পরিলক্ষিত হয়, এদিনের আনন্দের বাণে প্লাবিত হয় গোটা মুসলিম জাহান।

পরিশেষে বলব- ‘ঈদুল ফিতর’ সত্যিই তুমি অশান্তির মধ্যে শান্তি, হিংসার মধ্যে সম্প্রীতি আর অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য আনতে পুরোমাত্রায় সফল। তুমি বছর বছর ঘুরে-ফিরে আসবে এই প্রতীক্ষায় রইলাম।

সাংবাদিক-কলামিস্ট।