পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পবিত্র রমজান মাসে ব্যাংকে হামলা এবং একজন ম্যানেজারকে অপহরণ করে নেয়ার ঘটনার পর কেএনএফের নতুন করে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বান্দরবানে পর পর দুই দিনে ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা এবং একজন ব্যাংক ম্যানেজারকে জিম্মি করার পর র্যাবের অভিযানে ম্যানেজার মুক্তি লাভ করে পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন। ব্যাংক ম্যানেজার নিরাপদ ও সুস্থ শরীরে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ায় দেশবাসী স্বস্তি বোধ করছে। তবে এই ঘটনাটিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় পক্ষের কোনো মধ্যস্থতা ছাড়া পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করার পর পাহাড়ে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এতদিন পাহাড় নিয়ে সরকারের তেমন একটা দুশ্চিন্তা ছিল না। পাহাড়ের স্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে সেখানে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শেখ হাসিনা সরকার। মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্ত অপহরণের মতো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করার মতো ঘটনা ঘটেনি। সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে কেএনএফের এই তৎপরতার সঙ্গে অন্য কোনো গোষ্ঠীর মদদ থাকতে পারে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবাচনের আগে এবং নির্বাচন প্রতিহত করার পাশাপাশি নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কেএনএফ’র সঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো পক্ষের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসিত পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল কেএনএফ। ৯টি উপজেলা নিয়ে তারা পৃথক রাজ্য গঠন করতে চাচ্ছিল। এবার সেই দাবি থেকে সরে এসেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র এ গোষ্ঠী। তারা ওই অঞ্চলের সাতটি উপজেলা নিয়ে ‘স্বশাসিত পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছে। ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ নামে একটি পরিষদ গঠন করতে চায় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যার মাধ্যমে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখতে চায়। এছাড়া কুকি-চিন আর্মড ব্যাটালিয়ন (কেএবি) নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী করার দাবিও জানায়। গত শনিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসব দাবি জানায় কেএনএফ। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘কেএনএফ’ নামের একটি ফেসবুক পেজে দাবি সংবলিত পোস্টটি করা হয়। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং ভারতের মিজোরামে বসবাসরত বম জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমারের পালেতুয়া এলাকায় খুমি ও ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকজনকে ফিরিয়ে আনা।’ এর আগে বান্দরবানে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দুই দফায় মুখোমুখি সংলাপ হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি তৃতীয় দফা সংলাপ হওয়ার কথা থাকলেও এর আগেই মঙ্গলবার বান্দরবানের রুমায় ও বুধবার থানচিতে দফায় দফায় সশস্ত্র হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ব্যাংকে লুটপাট করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, এ হামলার জন্য দায়ী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এদিকে তিনটি ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এছাড়া সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করার কথা জানান তিনি। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর শনিবার তিনি বান্দরবান সফর করেন। তিনি রুমা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স, আনসার ব্যারাক, সোনালী ব্যাংক ও মসজিদ পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা একসময় খুব শান্তিপ্রিয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সন্ত্রাসীরা ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও অপহরণের মতো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এর আগেও এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে। এসব কার্যক্রম আমরা বিনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেব না। এদের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি না, তা বের করে আনা হবে। ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাহাড়িয়া এলাকায় অনেক সম্পদ রয়েছে এবং সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দরকার একটি স্থিতিশীল পরিবেশ। মিয়ানমারে সরকারবিরোধী একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতা বিদ্যমান। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ওই সব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘাত হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে তাদের ছোড়া গেলায় আমাদের দেশের মানুষ হতাহত হচ্ছে। মিয়ানমারের বিস্ফোরণের খবর বাংলাদেশ বসে শোনা যাচ্ছে। এমন একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতে কেএনএফের তৎপরতা সাদামাটা চোখে দেখার সুযোগ নেই। এই সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তা না হলে ওই এলাকার মানুষ শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে না। সেখানে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকবে না এবং সেখানকার চলমান ও আগামী দিনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। তাই সুচিন্তিত বিচার বিশ্লেষণ করার মধ্যদিয়ে পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।