অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্য

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা এবং ইরানের প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজিত করে তুলেছে। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় এমন অবস্থা বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের কনস্যুলেট ভবন ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। তাদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর (ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর-আইআরজিসি) দুই কমান্ডার রয়েছেন। নিহতদের সবাই যোদ্ধা ছিলেন বলে জানা যয়। এই প্রাণঘাতী হামলার কঠিন জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। সেই কঠিন জবাব আসলে কি হতে পারে তাই নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। যদি তা আরেকটি সামরিক সংঘাতে রুপ নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে। কারণ যুদ্ধ শুধুমাত্র ইরান আর ইসরাইলের মধ্যেই থেমে থাকবে না। এটি আরো বিস্তৃত হবে। ফলে সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইরান-ইরসাইল। আর এই যুদ্ধ শুরু হলে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য গতে কয়েক বছর ধরেই বেশ উত্তপ্ত হয়ে আছে। এর মধ্যেই ইরসাইল ফিলিস্তিনে হামলা চালালে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ইরানসমর্থিত ফিলিস্তিনি সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসের হামলার মাধ্যমে প্রায় ১,২০০ ইসরাইলি নিহত ও ২০০ জনেরও বেশি জিম্মি হওয়ার পর ইরান ও তার আঞ্চলিক প্রক্সিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল তাদের সামরিক অভিযান জোরদার করে। এরপর থেকে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এখন পর্যন্ত ইসরাইলি আগ্রাসন ৩২ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

সেখানে এখন খাবার, চিকিৎসা কোনোটিই নেই। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় সোলাইমানি নিহত হন। এই সেই কাশেম সোলাইমান যাকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ডের স্থপতি বলা হয়ে থাকে। সেই দাগ এখনও ইরানের মন থেকে যায়নি। তারপর আবার এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে আরো জটিল করে তুলবে। তাছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলও এখন ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে। পুরোপুরিভাবে একঘরে না হলেও অধিকাংশ দেশই তাদের এই কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে না। বিশেষত ত্রাণকর্মী নিহতের ঘটানার পর থেকে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে ইসরাইলের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রও ইসরালেই এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। এখন সকলেই চাইছে যুদ্ধ বিরতি। এখানে যুদ্ধ বিরতি হলে নতুন যুদ্ধ কি শুরু হতে যাচ্ছে? ইরান আর ফিলিস্তিন এক নয়। ফলে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ ইসরালকে আরো বেশি বিপদে ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খবরে জানা যায়, ইসরাইলি হামলায় নিহত ইরানি কমান্ডারের নাম মোহাম্মদ রেজা জাহেদি। তিনি ছিলেন আল-কুদস বাহিনীর একজন সদস্য। কাসেম সুলেইমানিকে হত্যার পর থেকে ইরানের সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের একজন তিনি। কাসেম সোলাইমানির পর তাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছিল বলেই বিশেষজ্ঞদের মতো। তার মৃত্যুতেই ইরানের যে বিশেষ ক্ষতি হয়েছে সে কথা বলা বাহুল্য। ফলে এবার ইরান কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। ইসরাইলও অনুমান করছে যে ইরান এ ঘটনায় চুপচাপ বসে থাকবে না বা শুধু হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সে ভাবনা থেকেই যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণও শুরু করেছে। অর্থাৎ একটি সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে যা করার করতে শুরু করেছে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এরমধ্যেই কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে গেছে তেল আবিব। জোরদার করা হয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। গত বৃহস্পতিবার থেকে বাতিল করা হয়েছে সেনাবাহিনীর ছুটি। বন্ধ করা হয়েছে দেশটির জিপিএস সেবা। যুদ্ধের শঙ্কায় আগের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খোলার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। তবে সরাসরি হামলার বিকল্পও রয়েছে ইরানের হাতে। যদিও ইরান সেটা করবে কি না তা ইরানের উপরেই নির্ভর করছে। শুধু ইসরাইলই সতর্ক অবস্থায় নেই, সতর্ক অবস্থায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ইরানের সম্ভব্য হামলা ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে ওয়াশিংটন। সিএনএন’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহে ইরান ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে এজন্য নিজেদের সম্পত্তি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সেখানে উচ্চ সতর্কতা আরোপ করেছে। গত সোমবার ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসে হামলা চালায়। এতে ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার নিহত হয়। উচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা ধারণা করছেন ইরান এরমধ্যেই আক্রমণে প্রস্তুত। এ ব্যাপারে ইসরাইলি কর্মকর্তারাও একই মতো পোষণ করেছেন। আসন্ন আক্রমণকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়- তা নিয়ে দুই দেশের সরকার একসঙ্গে কাজ করছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইরান খুব দ্রুত ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অবস্থা আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।

এই মুহূর্তে ইরানের আক্রমণ ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধকে বৃহত্তর ও আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে পারে। ইরান ইসরাইলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে থাকতে বলেছে। অর্থাৎ ইরান চায় না যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপার নিয়ে নাক গলাক। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের ঘনিষ্ট মিত্র। ইরান-সৌদি আরব ঐতিহাসিক চুক্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। এর পেছনে চীনের ভূমিকাও চীনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে দিয়েছিল। যদিও এক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কোনো লাভই হবে না বরং সংঘর্ষ বাড়বে এবং নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্থ হওয়ার পথে। গাজায় মানবেতর জীবন যাপন করছে নারী-শিশু ও পুরুষ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দরকার দুই পক্ষের সমঝোতা। এখন দেখার বিষয় কোন দেশ এই কাজটি করতে সক্ষম হয়। কূটনৈতিক সক্ষমতা যার বেশি, সেই কাজটি করতে পারে। আর যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে সেটি হবে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। তবে প্রশ্ন হলো- কাশেম সোলাইমানির পর এই হামলা কি ইরান শুধু হুমকি দিয়ে ছাড় দিবে?