বিচ্ছেদের আগে সন্তানের কল্যাণ ভাবনা

দাম্পত্য জীবনে একগুঁয়েমি নয়, চাই সমঝোতা

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সন্তানদের নিজ হেফাজতে রাখা সংক্রান্ত জাপানি মা ডা. এরিকো নাকানো ও বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের মধ্যেকার আইনি লড়াই অনেক দিন ধরে চলে আসছে। বাংলাদেশ ও জাপানের আদালত অঙ্গনে এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আইনি প্রক্রিয়া চলেছে। জাপান থেকে আইনি প্রক্রিয়া বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গণে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে তাদের দুটি কন্যাকে নিয়েই চলছে আইনি লড়াই। সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি। সন্তানের প্রতি তাদের দরদ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যে তারা তাদের সন্তানদের নিজ জিম্মায় না পেলে তাদের জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। তাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যাবে। জাপানি মা ও বাংলাদেশি বাবা কি তাদের মধ্যেকার পৃথক জীবনযাপনের আগে জানতেন না যে, সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না। সন্তান দাম্পত্য জীবনের সেতুবন্ধন। সন্তানের জন্য বাবা-মা অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারেন। তবে সন্তান নিয়ে মানুষ যাতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হচ্ছে যে কোনো দম্পতির প্রধান এবং প্রথম কর্তব্য। বাবা-মা পৃথক জীবনযাপন করলে সন্তানদের মনের ওপর কি ধরনের চাপ পড়ে, সেই ধারণা প্রত্যেক বাবা-মায়ের থাকা উচিত। সন্তান দূরে থাকার যে যন্ত্রণা, তার চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ কাটিয়ে দাম্পত্য জীবন কিছুটা যন্ত্রণার হলেও একসঙ্গে বসবাস করাটাই শ্রেয়। আমাদের দেশে বাস্তবতা হচ্ছে- মানুষ অধিকাংশ সময় আবেগ কিংবা ক্ষোভের বশীভূত হয়ে কিংবা একগুঁয়েমি থেকে দাম্পত্য জীবন ছিন্ন করে।

বাঙালি বাবা-মায়েরা সব সময় সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারের অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেন। দাম্পত্যজীবনে একজন স্বামী কখনো কখনো বিতর্কিত কিংবা দৃষ্টিকটু আচরণ করতে পারেন। যেটা স্ত্রী হিসেবে কোনো নারী মেনে নিতে পারেন না। আবার কোনো কোনো স্ত্রী এমন ভূমিকা পালন করেন, যা নিয়ে স্বামী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দাম্পত্য জীবনে কার কি পছন্দ কিংবা কে কি পছন্দ করেন না, সেটা অনুধাবন করা উচিত। তবে সব সময় মনে রাখা উচিত যে, স্বামীর আবেগ কিংবা অনুভূতির প্রতি যেমন স্ত্রী আঘাত করবেন না। তেমনি স্ত্রীর আবেগ কিংবা অনুভূতির প্রতি স্বামী কোনো প্রকার আঘাত হানবেন না। যদি কারো কাজে কারো হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিজেদের সংশোধন করে নিতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্তত ১০ বার ভাবা উচিত। ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। জাপানি মা কিংবা বাংলাদেশি বাবা হয়তো নিজেদের অতীতের কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করে সন্তানের প্রতি অত্যন্ত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন। নাকি তারা দাম্পত্য জীবনের জেদের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। সেটা বাইরে থেকে অনুধাবন করা কঠিন। সন্তান যার কাছেই থাকুক, সে যেন ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে, তার শিক্ষাজীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে, সেটা বাবাকে যেমন নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি মাও এ ক্ষেত্রে জোরাল ভূমিকা পালন করবেন। সন্তানদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখাই মুখ্য নয়। সন্তানের কল্যাণ কীভাবে নিশ্চিত হবে, সেটাই করতে হবে। বাবা-মায়ের বাইরে যেহেতু সন্তানরা থাকছে না, তাই তারা যেখানেই থাকুক ভালো থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বড় মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ার পর জাপানি মা ডা. এরিকো নাকানোর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করেছেন, সন্তানদের বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফ। আবেদনে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের স্থিতাবস্থা থাকার পরেও দেশত্যাগ করেছেন ডা. এরিকো। যা আদালতের আদেশের লঙ্ঘন। ১৫ এপ্রিল আবেদনটি উপস্থাপনের পর চেম্বার আদালতের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম বলেন, যেহেতু দেশত্যাগ করেছেন সেহেতু স্থিতাবস্থার আদেশ অকার্যকর হয়ে গেছে।

আদালত অবমাননার আবেদনটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে প্রেরণ করা হলো। আগামী ২১ এপ্রিল আদালত অবমাননার এবং স্থিতাবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জাপানি শিশুদের বাবা ও মায়ের করা পৃথক দুটি আবেদন শুনানির জন্য থাকবে। আদালতের আদেশের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ডা. এরিকোর কৌসুলি অ্যাডভোকেট মো. শিশির মনির। তিনি বলেন, গত ৯ এপ্রিল বেলা ১টায় আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশ হওয়ার আগেই বেলা ১১টার দিকে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে তারা দেশত্যাগ করেন। শিশির মনির বলেন, হাইকোর্টের রায়ের কোথাও বলা নেই বাবা ও মা সন্তানদের নিয়ে দেশত্যাগ করতে পারবেন না। তবে আগামী ২১ এপ্রিল আপিল বিভাগে এই মামলার শুনানির দিনধার্য রয়েছে। এর আগেই বাংলাদেশে ফিরে আসবেন জাপানি মা ও তার সন্তান। ডা. এরিকোর স্বামী ইমরান শরীফের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, সন্তানদের দেশের বাইরে যেতে আদালতের স্থিতাবস্থা ছিল। তা সত্ত্বেও বড় সন্তানকে নিয়ে নাকানো এরিকো চলে গেছেন। এ কারণে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান এক রায়ে জাপানি দুই শিশুকে মায়ের হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল করেন ইমরান শরীফ। সেই আপিল খারিজ হয়ে যায়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা করেন তিনি। সেই মামলার শুনানি শেষে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, জাপানি দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে জেসমিন মালিকা থাকবেন মা ডা. এরিকো নাকানোর জিম্মায়। আর মেঝো মেয়ে লাইলা লিনা থাকবেন বাবা ইমরান শরীফের কাছে। তবে উভয় সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মা যেন সাক্ষাৎ করতে পারেন সেই অধিকার তাদের নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত আপিল আংশিক মঞ্জুর করে এই রায় দেন বিচারপতি মামনুন রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বাবা ও মা দু’জনেই পৃথক পৃথক আবেদন করেছেন। অবশেষে আইনি লড়াই কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।