ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনীতি বিমুখতায় ছাত্রছাত্রীরা!

রাজু আহমেদ
রাজনীতি বিমুখতায় ছাত্রছাত্রীরা!

আমাদের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির পরতে পরতে ছাত্র রাজনীতির গৌরবগাঁথা কিংবদন্তি আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচার পতন পর্যন্ত প্রত্যেকটি জাতীয় আন্দোলনে কিংবা সব সংকটে ছাত্র রাজনীতি সোনালি পদচিহ্ন রেখেছে। একসময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারাটা অত্যন্ত গৌরবের ছিল। এখন ছাত্ররাই বলছে, রাজনীতিবিদদের ছাত্র রাজনীতি আমাদের কাছে এনো না। রাজনীতি বিমুখতায় ছাত্র ছাত্রীরা বেশ সরব ও সচেতন এখন! বিগত দুই দশকে ছাত্র রাজনীতি কল্যাণকর কিছু উপহার দিয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের সামনে গৌরবময় কোন অর্জনের দৃষ্টান্তে রেখেছে, এমন নজির চলমান ছাত্রছাত্রী কিংবা সদ্য সাবেক হওয়া শিক্ষার্থীদের সামনে নেই। বরং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো অনেক অনাচার-অত্যাচারের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছে।

ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্যই ছিল ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা! কারো কারো অর্থ ও ক্ষমতার কল্যাণ যে হচ্ছে না, সেটাও বলা যাচ্ছে না! কেউ কেউ নিশ্চয়ই ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে! তবে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা, হলে হলে মারামারি-নির্যাতন, ডায়নিংয়ে টাকা না দেওয়া, গণরুমের শোচনীয় অবস্থা, ভাঙচুর, রাত-দুপুর শিক্ষার্থীদের মিছিল-মিটিংয়ে যেতে বাধ্য করা, বায়বীয় অভিযোগে ভিন্নমতকে দমন ও হত্যা করা, শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করা কিংবা শিক্ষকদের অপদস্থ করা- এসব ছাত্র রাজনীতির ক্যাম্পাসের আভ্যন্তরীণ চালচিত্র! আদর্শিক চরিত্রের অনুপস্থিতিতে এবং নৈতিক অধঃপতনে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মতো অপকর্মেও ছাত্র রাজনীতির সংশ্লিষ্টতার কথা আসছে, প্রমাণ মিলছে! কোথাও কোথাও ছাত্র রাজনীতি আর নিয়মিত ছাত্রদের দখলে নেই। বুড়ো ছাত্র, স্বামী ছাত্র কিংবা বাবা ছাত্র নেতৃত্ব দিচ্ছে! তাইতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় মা সন্তানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে- বাবা, রাজনীতি থেকে দূরে থাকিস! ঠিকমতো লেখাপড়া করিস! অথচ স্বাধীনতার আগের সময়ে কিংবা পরবর্তীকালে সন্তানদের প্রতি মায়েদের নির্দেশনা ভিন্নরকমের ছিল!

সাম্প্রতিককালে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই মন্দ কিছু নয় বরং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে জাতীয় নেতৃত্বের জন্য যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠার ময়দান। তবে বর্তমানে যে রীতিতে ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে, নীতি প্রীতির চেয়ে ভাই প্রীতি বাড়ছে, তাতে এই রাজনীতি কল্যাণকর কিছু আনবে না। ছাত্র রাজনীতি একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণকামীতায় কাজ করে, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে মতামদর্শের প্রচারে সহায়তা করে। কিন্তু মারামারি, হানাহানির যে নীতি, উগ্রতা ও দমনের যে কৌশলে ছাত্ররাজনীতি কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করছে, তা মারাত্মক বিপজ্জনক। ছাত্র রাজনীতি যখন ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতিবিদদের গুটি হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে, তখন একটা প্রজন্মকে বিপথগামী করে! কিশোর গ্যাংয়ের ভূমিকা আর ছাত্র রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অদল-বদল হয়ে গেলে সেটা জাতির আগামীর জন্য এলার্মিং। বিগত দেড়যুগ ক্ষমতাশীনদের ছাত্রসংগঠন সর্বত্র একচেটিয়া তাদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার ও প্রসার করেছে! অবস্থা এমন, স্কুলে-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে এখন যে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কথা নয়! বাংলাদেশের কোন ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কাগজ-কলমের বাইরে কোনো তৎপরতা আছে বলে দৃশ্যমান নয়! ছাত্রশিবির গোপনে গোপনে কিছু কাজ করছে! অন্যান্য দলের যেসব ছাত্রসংগঠন তা নামকাওয়াস্তে বছরো দু-একবার পত্রিকায় আসে! যেখানে এককভাবে ছাত্রলীগের অবস্থান সেখানে তাদের মধ্যকার গ্রুপিং, মারামারি কিংবা খুন-জখমণ্ডআতঙ্ক সৃষ্টিকারী হিসেবে মোটেও তুচ্ছ কিছু নয়! আবরার ফাহাদ, আবু বকর কিংবা বিশ্বজিতদের দমন-পীড়নের আতঙ্কে সাধারণ ছাত্র রাজনীতিতে সংক্রিয় হওয়ার বদলে ঘৃণা করছে বেশি! শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র রাজনীতি উপহার দিচ্ছে, মায়ের কোল খালি করে সন্তানের লাশ! তরুণ প্রজন্মের একাংশ ‘আই হেইট পলিটিক্স’ বললে অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না। সেই যে সোনালি প্রজন্মের ছাত্র রাজনীতি, গৌরব ও বিস্ময়ের ছাত্র রাজনীতি, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনের স্লোগান কিংবা দেশি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে ছাত্র রাজনীতি ইস্পাত-দৃঢ় অবস্থান-সেই নীতি-আদর্শ আজকের ছাত্র রাজনীতির মধ্যে খুঁজে না পাওয়াটা খুবই হতাশাজনক। উত্তরাধিকার সূত্রে ভালোটুকু আমলে নিলাম না- এই আফসোসে আগামীতে দাঁড়িয়ে আজকের ছাত্র রাজনীতির মূল্যায়ণ ও ইতিহাস লিখতে হবে। যেখানে গৌরব করার কোনো রসদ থাকবে না। শুধু অন্যায়-অনাচারে বসতটুকু দেখানো যাবে। শুধু ছাত্রলীগ নয় বরং ছাত্রদল, ছাত্রশিবির কিংবা অন্যান্যদের ছাত্র সংগঠন- যারাই ক্ষমতাবানদের লেজুড় হয়েছে, তারাই বিপথগামী হয়েছে। ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের বাতাস লাগানো এসব ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য করেছে। একজন ছাত্র রাজনীতিবিদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ হয়ে যাবে, দলীয় রাজনীতির আদর্শের বাইরেও তার শত শত ভাই-অনুসারী লাগবে ও থাকবে- এসব দৃষ্টান্তে বর্তমান ও আগামীর জন্য আশাব্যঞ্জকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সব নাগরিকের রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিছু কিছু ক্যাম্পাস মেজরিটি শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী রাজনীতি মুক্ত রেখে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা ফলাফল দেখতে পারেন! এতদিনের বুয়েট মন্দ চলছিল না! খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিমুক্ত থেকে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গেই চলছে। রাজনীতি চাপিয়ে দিলে দমন-পীড়ন আরো বাড়বে। যে ছাত্র রাজনীতি কল্যাণকর সেই রাজনীতি যাতে শিক্ষাঙ্গনে কায়েম হয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নিরাপদে থেকে শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকে- সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত