ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাতাসে যেন আগুনের হলকা!

প্রদীপ সাহা
বাতাসে যেন আগুনের হলকা!

প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে রাজধানীসহ প্রায় গোটা দেশই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমে-ঘামে হাঁপাচ্ছে মানুষ; হাঁসফাঁস অবস্থা প্রাণিকুলের। বাতাসে যেন আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ছে। সকালে সূর্যের তাপ একটু সহনীয় হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে তাপের তীব্র তেজ আর উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। গরমের সঙ্গে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ধুলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ বাড়ছে। কাঠফাটা রোদ আর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুড়ছে প্রকৃতি। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াটাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। উত্তাপের তীব্রতা এতটাই বেশি যে, রাস্তার পিচ গলে যাচ্ছে; ফসল পুড়ে যাচ্ছে। গায়ে যে বাতাস লাগে, তা ছ্যাঁকা লাগার মতো অনুভূত হয়। থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা, হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। অসহনীয় গরমে ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। গত ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৬ এপ্রিল ২০২৪ চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ১৯৬৫ সালের পর অর্থাৎ ৫৮ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। এ তাপমাত্রা কোথাও কোথাও বেড়েই চলেছে প্রচণ্ডভাবে। গত ২০ এপ্রিল ২০২৪ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তীব্র তাপপ্রবাহ শহরগুলোর জন্য বেশি বিপজ্জনক এবং প্রতি বছর শহরে ক্রমাগত ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষায় ‘অতি তীব্র তাপপ্রবাহ’ চলছে দেশে। তাপমাত্রা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হলেই তা অতি তীব্র তাপমাত্রা ধরা হয়। তাই চিকিৎসকরা বলছেন যে, সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং তাপ এড়িয়ে চলতে হবে। বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রসীমায় আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে চলতে শুরু করেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বর্তমান জলবায়ু সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আজ প্রকৃতির কঠিন রূপ আমাদের দেখতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আজ খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, উজানে পানির ঢল এসব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের প্রভাবে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে তাপমাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং উষ্ণতাপ্রবণ এলাকা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিকমহলে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বারবার বলেছেন, গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস বা বন্ধ না করা হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো বাড়বে এবং এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাবে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে দ্বিগুণ বাড়ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই-অক্সাইড বেড়ে গেলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া ঘটে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বন নিধন, ব্যাপক শিল্পায়নসহ অন্যান্য দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্টকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন ও ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৩ লাখ ৫০ হাজার বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণ বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে গত ৩৩০ বছরে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে এবং গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ার ফলে উৎপাদিত হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্প্রে, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার প্রভৃতি যন্ত্র থেকে সিএফসি গ্যাস নির্গত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব গ্যাসের প্রভাবে অতিমাত্রায় সূর্যতাপ পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলে আটকা পড়ে মারাত্মক গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। গ্রিন হাউজের এ প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ এবং জনজীবন তথা সমগ্র পৃথিবী আজ হুমকির সম্মুখীন।

জলবায়ুর প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তাপ। আর পৃথিবীতে এ তাপশক্তির মূল উৎসই হচ্ছে সূর্য। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুর নজিরবিহীন পরিবর্তন ঘটে। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণই হচ্ছে গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। সাধারণ অবস্থায় সূর্য থেকে যে তাপশক্তি আসে, তার কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং বেশিরভাগই প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে যে কার্বনডাই-অক্সাইড, মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস জমে আছে, তা ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত তাপ শোষণ করে এবং ভূমণ্ডলের তাপ বিকিরণে বাধা দেয়। ফলে পৃথিবীর উপরিভাগ ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে এবং আমরা পুড়ছি তীব্র তাপপ্রবাহে।

আবহাওয়াবিদদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। এর ফলে দেশে তাপপ্রবাহ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনোর প্রভাব কমলেও গত বছরের মতো এবারও তাপপ্রবাহ দীর্ঘ হবে। তীব্র তাপমাত্রার কারণে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে, তেমনি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতেও সংকট দেখা দেবে। এপ্রিল বছরের উষ্ণতম মাস। এই বিশেষ অবস্থা আগামী জুন পর্যন্ত থাকতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হওয়ার প্রতিক্রিয়া আরো ভয়াবহ হতে পারে। এ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের বিদ্যুৎ এবং সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবহারে অপচয় রোধ করতে হবে এবং দক্ষতা বাড়াতে হবে। সৌর ও অন্যান্য শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গৃহস্থালী ও শিল্প-কারখানার আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। সর্বোপরি অধিক হারে বনায়ন বাড়াতে হবে এবং বন উজাড়ের প্রবণতা রোধ করতে হবে। আমরা এখন ভবিষ্যতের একটা ডেমো দেখতে পাচ্ছি। এটা মরুকরণের একটি প্রাথমিক লক্ষণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেভাবে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা- তাতে গভীর এক শঙ্কা সহজেই নাড়া দিচ্ছে বারবার। প্রশ্ন জাগছে, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমরা কেন সবাই মিলে সচেতন হতে পারছি না?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত