বই পড়ার অনাগ্রহ : নবীন প্রজন্মের জীবন মরুভূমি হচ্ছে

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনৈক মনীষীর বক্তব্য হলো, ‘আমাদের শিক্ষিত সমাজের লোলুপ দৃষ্টি আজ অর্থের উপরেই পড়ে রয়েছে, সুতরাং সাহিত্য চর্চার সুফল সম্বন্ধে আমরা অনেকেই সন্দিহান। যারা হাজারখানা ল’ রিপোর্ট কিনেন, তারা একখানা কাব্যগ্রন্থও কিনতে প্রস্তুত নন। কেন না, তাতে ব্যবসার কোনো সুসার নেই। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী বলেন- ‘যেখানে ছেলেমেয়েদের বিদ্যা গিলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক, এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যারা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির প্রধান উপায় মনে করেন। গোদুগ্ধ অবশ্য অতি উপাদেয় পদার্থ, কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করার শক্তির উপর নির্ভর করে, এ জ্ঞানও শ্রেণির মাতৃকূলের নেই। তাদের বিশ্বাস ও বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। কাজেই শিশু যদি তা গিলতে আপত্তি করে, তাহলে সে ব্যায়াড়া ছেলে, সে বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। অতএব, তখন তাকে ধরে বেঁধে জোর-জবরদস্তি করে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যায়। শেষটা সে যখন এ দুগ্ধপান ক্রিয়া হতে অব্যাহতি লাভ করার জন্য মাথা নাড়তে, হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করে, তখন স্নেহময়ী মাতা বলেন, ‘আমার মাথা খাও, মরা মুখ দেখো ইত্যাদি। মাতার উদ্দেশ্যে যে খুব সাধু, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, ওই কথা বলার ফলে শুধু ছেলের যকৃতের মাথা খান। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষা-পদ্ধতিটাও ওই একই ধরনের।’ বর্তমানে বাড়িতে ওই পদ্ধতি আরো কঠোরভাবেই বলবৎ করা হয়েছে। কেন না, এ যুগের পিতা-মাতারা সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে আরো সিরিয়াস হয়েছেন। তাই এদের গল্পের বই পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ‘শকুন্তলা’য় বিদ্যাসাগর বলেছিলেন,’ বুঝিলাম স্নেহ অতি ভীষণ বস্ত। আপত্য স্নেহে বশীভূত মা-জননীরা কখনও কখনও ছোট ছোট সন্তান-সন্তুতিদের টিভির সম্মুখে বসতে দেন। এটা অবসর বিনোদনের মোক্ষম দাওয়াই তথা জোরে বলে বিদ্যা গেলার উপযুক্ত পুরস্কার বা বোনাস হিসাবেই তারা আদায় করে নিচ্ছে। পড়াশোনার ‘ফাঁক’ এর সঙ্গে টিভি সিরিয়ালের সময়ের তালমিল বজায় রাখতে না পেরে কচি-কাঁচারা শিশু মনের সিরিয়াল দেখা থেকে প্রায়ই বঞ্চিত হচ্ছে। অবশ্য এতে এদের কী-ই বা যায় আসে? যা তা একটু কিছু দেখতে পেলেই তো ওরা ধন্য হয়ে যায়।

বাহুল্য হলে ক্ষমা করবেন, এ যুগের কিশোর-কিশোরীরা এখন আর মা-বাবার লক্ষ্য গল্পের বই পড়া তো দূরের কথা, সিংহভাগ কিশোর-কিশোরীদের পাঠ্যপুস্তকের পাতায়ও আর মনে থাকে না, মন থাকে ঘরের ওই বোকা বাক্সের পানে। সুযোগ পেলেই তাদের ওই বোকা বাক্সের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। সে বাক্স অর্থাৎ টিভিই হচ্ছে তাদের পরম কাম্য বস্তু। টিভির প্রশ্নে নবীন প্রজন্মের কাছে এ যুগের অভিভাবকরা হার মেনে নিয়েছেন। বোকা বাক্সের সামনে এক মুহূর্তও তাদের নিশ্চিন্তে বসার উপায় নেই। পর্দায় মুহুর্মুহু ভেসে আসছে স্বল্পবাস ললনাদের শরীরী পসরা। টিভির ধারাবাহিকে মুনাফাখোর প্রযোজক-পরিচালকরা ললনাদের নামমাত্র পোশাকে হাজির করছেন? এর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলছে কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপনের লেলিহান দৃশ্য। তাই আজকের দিনের বয়স্কদের কারও সাধ্য নেই ঘরে বসে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে টিভি দেখেন। ফলে ঘরের প্রাণকেন্দ্র বোকা বাকসে এখন এদেরই একচেটিয়া অধিকার। বাবা দিনভর বাইরে থাকেন, মা থাকেন সংসারের কাজে ব্যস্ত। অতএব, এটা এদেরই ব্যক্তিগত সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাৎক্ষণিক আনন্দ লাভের আশায় আজকাল যুব সমাজের গল্প উপন্যাস পড়ার মোটেই অবকাশ নেই। রাত জেগে টিভিতে তারা শুধু পশ্চিমা রীতির জীবনযাপন প্রণালী এবং যৌনতা তপ্ত ছবি দেখে চলেছে। কেউ জানে না, এর শেষ কোথায়, সমাপ্তি কোথায়? কারও কারও হাতে হয়তো বা কখনও কখনও দু’একটি একটি ম্যাগাজিন দেখা যায়। তবে আজকের দিনের প্রায় সবকটি ম্যাগাজিনের ভূমিকা খুবই ন্যাক্করজনক এবং এগুলোরই কাটতি বেশি। যে কোনো ম্যাগাজিনের দোকানে দাঁড়ালে দেখা যায়, সেখানে বেশিরভাগই কুরুচিপূর্ণ প্রচ্ছদযুক্ত ম্যাগাজিন ঝোলানো রয়েছে।

বাইরের প্রচ্ছদপট দেখে ভেতরের সারবত্তা সহজেই আঁচ করা যায়। মোট কথা ঘরে ঘরে টেবিলে টেবিলে সিনেমা ও সিরিয়ালের দৌলতে নবীন প্রজম্মদের বই পড়ার প্রয়োজন আজ ফুরিয়ে গিয়েছে। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়নের সুবাদে বিগত ৩৪ বছরে আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি এমন দ্রুতগতিতে পাল্টে যাচ্ছে, যা এর আগে শত বছরেও এরূপ দেখা যায়নি। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে অর্থাৎ আমাদের সময়ে ‘বই পড়া’ ই ছিল অবসর বিনোদনের একটা প্রধান অঙ্গ। খেলাধূলার মতো এটাও ছিল একটা অন্যতম হবি বা শখ। সে সময়ে আমরাও ক্লাব গঠন করেছি, তবে এর প্রধান শর্ত ছিল নিদেন পক্ষে অন্তত শ’ দুয়েক বই ক্রয় করে তাতে পাঠাগার স্থাপন করা। আজকাল পাড়ায় পাড়ায়, গলিতে গলিতে অসংখ্য ক্লাব গঠিত হচ্ছে, তবে উপরোক্ত শর্তের লেশমাত্র চিহ্নও চোখে পড়ছে না। পরবর্তীতে আজকের দিনের ক্লাবগুলোকে টিভি, সিডি, ডেক ইত্যাদির ছড়াছড়ি এবং নানা হইচই।

তখনকার দিনে অভিভাবকরা আমাদের পড়াশোনার খুব একটা খবর না রাখলেই চলত। কেন না, বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষকের উপরই ছিল তাদের ষোলআনা ভরসা। তাদের সে ভরসা পুরো মাত্রায়ই ফলপ্রসূ হয়েছে। স্কুল, কলেজ জীবনে পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আমরা স্কুল ও কলেজ লাইব্রেরি থেকে নানা বই সংগ্রহ করেছি। এছাড়া জেলা গ্রন্থাগার এবং মহকুমা গ্রন্থাগারেও ছিল আমাদের নিত্য আড্ডা। আজও এসব পাঠাগার সরকারি পয়সার বিস্তর অপচয় করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পাঠকের অভাবে ওইসব গ্রন্থাগারের লক্ষ্মীছাড়া দৈনদশা বাস্তবিকই বেদনার সঞ্চার করে। কোথাও যেন প্রাণের পছন্দ নেই। সেদিন আমাদের শিক্ষিত অথবা অর্ধশিক্ষিত প্রতিটি পরিবারের ঘরে ঘরে ভালো ভালো সাহিত্য ম্যাগাজিন শোভা পেত। আমরা নামীদামী, জ্ঞানী গুণী লেখক-লেখিকাদের গল্প উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত পাঠ করেছি। তবুও যেন আশা মিটেনি। তাই পরে বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগুলোকে ‘যেন তেন কারে’ লুফে নিয়েছি। তাছাড়া ভৌগলিক-ঐতিহাসিক-বৈজ্ঞানিক নানা গ্রন্থও সুযোগ পেলে আমরা পাঠ করেছি। এগুলো ব্যবহারিক জীবনে জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সাহিত্যিক অঙ্গনে অবাধে বিচরণের ফলস্বরূপই তখনকার মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে এখনকার প্রজন্মদের মূল্যবোধে বিস্তর ফারাক দেখা দিয়েছে।

আজকের যুব সমাজ হতাশাগ্রস্ত, উদাসীন। তারা কেমন যেন মনমরা। বই পড়ার অভাবেই তাদের মন ‘সবল সচল সরাগ ও সমৃদ্ধ হওয়ার উপাই নেই। বড় হওয়ার পরিবর্তে দিনে দিনে তাদের মনের পরিধি আরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মানবিকতা, মূল্যবোধ এসব দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খাতিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ক্ষণিকের জন্য স্থল রুচির আমোদণ্ডপ্রমোদ উপহার দিচ্ছে সত্যি তবে এগুলো তাদের মনে স্থায়ী প্রশান্তির কোনো প্রলেপ সিঞ্চন করছে না। এদের জীবন বিশুদ্ধ মরুভূমির দিকে সবেগে ধাবিত হচ্ছে। বই পড়ার অভাবে প্রকৃতার্থে জ্ঞানের বর্তিকা ছাড়াও টিভি থেকে আয়ত্ব স্থূল রুচির ক্ষণস্থায়ী আবেগকে মূলধন করে নবপ্রজন্মরা ব্যবহারিক জীবনে পদার্পণ করছে। সেখানে ব্যথা, বেদনা ও নৈরাজ্যের হাহাকার ছাড়া ওদের জন্য আর কী-ই বা অপেক্ষা করতে পারে?

বাস্তব সত্য এই যে, যে দুবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পাচ্ছে না তার জরাজীর্ণ বেমানান ভাঙা ঘরেও আজ যেমন করেই হোক একটা টিভি অবশ্যই শোভা পাচ্ছে! এটা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হিসাবেই গণ্য করতে হবে। তবে বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত মুনাফাখোর একশ্রেণির ব্যবসায়ী সমাজ এটাকে সৎ উদ্দেশ্যে অথবা সৎ কাজে ব্যবহার করছেন না। রাষ্ট্রযন্ত্র এখন প্রায় বিকল হয়ে পড়েছে। কেন না, সরকার এদেরই হাতের পুতুল। তাই টিভির করাল গ্রাস থেকে কীভাবে নবীন প্রজন্মদের মুক্ত করে বই পড়ার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আন্তরিক আবেদন রাখছি।