মানবসৃষ্ট বিপর্যয় থেকে পৃথিবী রক্ষা করতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসমেত ধার্য করা একটি দিবসই হলো ধরিত্রী দিবস। পরিবেশ রক্ষার জন্য সমর্থন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ধরিত্রী দিবস একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান যা প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২২ এপ্রিল পালিত হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিবসটি পালিত হয় এবং বর্তমানে আর্থ ডে নেটওয়ার্ক কর্তৃক বিশ্বব্যাপী সমন্বিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩ সংখ্যারও অধিক দেশে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও তে ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেটি জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক (ইউএনসিইডি) সম্মেলন বা ধরিত্রী সম্মেলন (পর্তুগীজ ইসিও ৯২) নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের পর এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলো যাতে টেকসই উন্নয়নের জন্য একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা। এ সম্মেলনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো ছিল- ১) উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী যাচাই-বাছাইকরণ, বিশেষত বিষাক্ত উপাদানের ক্ষেত্রে, যেমন গাসোলিনে লেডের উপস্থিতি, তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য ইত্যাদি। ২) জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে কমাতেও সাহায্য করবে ৩) যানবাহন থেকে সৃষ্ট দূষণ কমাতে, বায়ুদূষণজনিত সমস্যা কমাতে এবং শহর এলাকায় ভিড় কমাতে গণপরিবহনের উপর মানুষের নির্ভরতা সৃষ্টি করা, এবং ৪) পানির ব্যবহার ও উৎসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এই সম্মেলনের অন্যতম অর্জন হলো জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক চুক্তি যা পরবর্তীতে জাপানের কিয়োটো প্রোটোকল এবং প্যারিস চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া এ সম্মেলন ১) জীববৈচিত্র্যবিষয়ক চুক্তি, ২) জলবায়ু পরিবর্তনের চুক্তি বাস্তবায়নের কাঠামো এবং ৩) মরুকরণ রোধে জাতিসংঘের নীতি প্রণয়নের পথ সুগম করে।

আসলে মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবেশের ভারসাম্য ও জীবন রক্ষাকারী উপাদানকে অপব্যবহার ও অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন করে পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে চলেছে। মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বৃক্ষনিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, যুদ্ধবিগ্রহ, পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার অন্যতম। যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থে ও জীবনের উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার করে চলেছে। মানুষের অপতৎপরতা, বিশেষ করে বিজ্ঞানের উন্নতির পর থেকে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ অজস্র ছোট-বড় প্রাণী, গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ সাধন করেছে। এসবের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ বিশ্বের জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি।

উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ ওতোপ্রতভাবে জড়িত এবং এদের সমাবেশই হলো জীববৈচিত্র্য। ভূপৃষ্টে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ও এদের জড় পরিবেশ নিজেদের মধ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গতিময় পদ্ধতি হলোই পরিবেশতন্ত্র। মানুষসহ অধিকাংশ প্রাণীর খাদ্যের প্রধান উৎস বৃক্ষ ও প্রাণিসম্পদ। নির্বিচারে বন নিধন এবং প্রাণী শিকারের কারণে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও পশুপাখি বিলুপ্তির পথে। পানি দূষণ, জলাশয় সমস্যা এবং অবাধে শিকারের কারণে বহু ছোট-বড় নানা জাতের দেশি মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। মৌমাছিসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ফুল থেকে মধু আহরণকালে পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অণুজীবগুলো মরা বৃক্ষ ও প্রাণীর কোষের জৈবপদার্থ খেয়ে বাঁচে এবং এসব মাটির সঙ্গে পঁচিয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখে। বিভিন্ন জীবস্তরের মধ্য দিয়ে খাদ্যশক্তির এ প্রবাহকে খাদ্য শৃঙ্খল বা ফুড চেইন বলে। খাদ্য শৃঙ্খল ইকোসিস্টেমের গতিশীলতা বজায় রাখে। কিন্তু মানব সৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে ইকোসিস্টেম মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন, যা আমাদের পরিবেশ ও প্রাণিসম্পদকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

পরিবেশ দূষণ রোধ করতে জীবমন্ডলের সার্বিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতা বজায় রাখার কারণে জীববৈচিত্র্য আবশ্যক। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য। জীববৈচিত্র্য হলো প্রকৃতপক্ষে বিপুলসংখ্যক জিনের ভান্ডার। বিভিন্ন জীবের এই জিন ভান্ডার মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। এই জিন ভান্ডারে অসংখ্য উত্তম গুণসম্পন্ন জিন রয়েছে, জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে যা সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীতে স্থানান্তরিত করে পছন্দসই গুণসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এর দ্বারা মানব জাতির ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ২০১৪ সালের মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো উঠে আসে। ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ ক্রমাগত বাড়ছে। একইভাবে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে? মনুষ্য সৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ক্রমেই আগামী বিশ্ব বিপদজনক হয়ে উঠছে। অন্যদিকে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ও সুবিধা থেকে এসব মানুষ বঞ্চিত। অথচ পৃথিবী ধ্বংসের জন্য উন্নত দেশগুলো মরণাস্ত্র তৈরির পেছনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এসব না করে উন্নত দেশের নেতৃবৃন্দ আজ যদি তাদের সময়, শ্রম এবং অর্থকে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয় রোধের জন্য ব্যয় করত তাহলেই বরং বিশ্ববাসী উপকৃত হত এবং শান্তি পেত। মরণাস্ত্র তৈরির জন্য যেই বাজেট ব্যয় হচ্ছে, সেই বাজেটের সিকি ভাগও যদি আজ মানব জাতির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য ব্যয় হত, তাহলে পৃথিবী আজ ক্ষুধা এবং দারিদ্রতা মুক্ত হত। আর এটাই হত সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চা। যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সেই দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রজাতির জীব, প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তোলে। এ সম্পদের নমুনা চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো হয়। ফলে নান্দনিক সৌন্দর্য ও শিক্ষাগত মূল্যবৃদ্ধি পায়।