ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে নীতিমালা

নারীর মানবাধিকার নিশ্চিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ
সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে নীতিমালা

সন্তান যে কোনো দম্পত্তির জন্য মহান আল্লাহর নিয়ামত, বরকত ও দাম্পত্য জীবনের সেতুবন্ধন। যতদিন দাম্পত্য জীবন সুখ-শান্তিতে কাটতে থাকে, ততদিন সন্তানরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। সংসারে অভাব অভিযোগ থাকলে সেটা সন্তানের পিতামাতা হজম করে নেন। দরিদ্রতার কারণে সন্তানদের চাহিদা পিতা-মাতা পূরণ করতে পারছেন না, সেটা সন্তান বুঝতে পারলে তাদের তেমন কোনো আফসোসবোধ থাকে না। তবে পিতা-মাতার মধ্যকার অবনতিশীল সম্পর্কের সঙ্গে অসহায় সন্তানরা সমন্বয় করতে পারে না। অবনতিশীল সম্পর্ক মেনে নিতে পারলেও সন্তানরা কোনো অবস্থায় তাদের পিতা-মাতার মধ্যকার বিচ্ছেদ চায় না। সন্তানরা যে কোনো মূল্যে পিতামাতা উভয়ের সঙ্গে বসবাস করতে চায়। তবে নানা কারণে পিতা- মাতার মধ্যেকার সম্পর্ক অনেক সময় টিকে না। কার দোষে সংসার টিকে না সে বিচার করার মতো পরিস্থিতি সন্তানদের থাকে না। তারপরও হয়তো একসময় হয়তো পিতা-মাতার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তখন সন্তানরা পড়ে যায় মহাসংকটে। তারা কার সঙ্গে থাকবে, তাদের খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ কে বহন করবে, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সামাজিকভাবে সন্তানদের ভরন পোষণের ব্যয়ভার নির্ধারণের ব্যাপারে আপসরফা হলেও সন্তান কার সান্নিধ্যে থাকবে, তা নিয়ে শুরু পিতা-মাতার মধ্যকার লড়াই। বিচ্ছেদের আগে সন্তানের দরদ বুঝতে না পারলেও পরবতীতে পিতা-মাতা বুঝতে পারেন সন্তান মহান আল্লাহ কী নিয়ামত। কিন্তু তখন আর আফসোস করা ছাড়া আর করার মতো কিছু থাকে না। এসব সন্তান নিয়ে পারিবারিক আত্মীয়-^জনদের মধ্যেও নানা অস্থিরতা বিরাজ করে। সবচেয়ে কঠিন সংকট তৈরি হয় সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে। বাংলাদেশের এমনি এক সাামাজিক প্রেক্ষাপটে সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণের নির্দেশিকা এবং নীতিমালা প্রণয়ন করে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এজন্য একটি কমিটি গঠনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্ব থেকে নারী বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সোমবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। থিঙ্ক লিগ্যাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারীপক্ষ এবং একাডেমি অব ল অ্যান্ড পলিসি (আলাপ) এর পক্ষে যৌথভাবে এ রিট করা হয়। রুলে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ এর ১৯ (খ) ধারাকে কেন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী এবং সংবিধানের সঙ্গে বিশেষত, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ (মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইনসমূহ), অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের চোখে সমতার অধিকার) এবং অনুচ্ছেদ ২৮ (লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়েছেন। একইসঙ্গে অভিভাবকত্ব নির্ধারণের নির্দেশিকা এবং নীতিমালা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে প্রস্তুতকৃত নির্দেশিকা এবং নীতিমালাটি রুল জারির চার মাসের (৪ আগস্ট) মধ্যে আদালতে জমা দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইনজীবীরা বলছেন নারীর মানবাধিকার নিশ্চিতের পথে এটি একটি যুগান্তকারী আদেশ। সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণবিষয়ক এ আইনটি একবিংশ শতাব্দীতে কোনোভাবেই প্রযোজ্য হতে পারে না। নাবালকের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্ব-বিষয়ক এ আইনটি সংশোধন হলে সমাজে নারীর সমণ্ডঅধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। কেন না, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি মা ও মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করলেও নারীর প্রতি সর্বদা হীন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে। সন্তানের অভিভাবকত্ব ও প্রতিপালনবিষয়ক প্রচলিত আইনেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। বৈষম্যমূলক এসব আইনের কারণে অধিকাংশ নারীকে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তান না পাওয়ার বঞ্চনা ও বেদনা নিয়েই থাকতে হয়। তবে এ প্রগতিশীল আদেশ অভিভাবকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এ আদেশটি পরিবারের অভ্যন্তরীণ এবং শিশুদের অভিভাবকত্ব-বিষয়ক অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীদের সমতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এবং একইসাথে, ঔপনিবেশিক কাল থেকে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইন, প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণা দূর করে প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত