ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশ গঠনে সংবাদপত্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
দেশ গঠনে সংবাদপত্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারা

১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ নাগরিক জেমস অগাস্ট The Indian Gayette or Calcutta General Advertiser প্রথম প্রকাশের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সত্যনির্ভর সংবাদ ছিল এর লক্ষ্য। এর ধারাবাহিকতায় অদ্যবদি সংবাদপত্র নানাভাবে বিকশিত ও প্রকাশিত। সময়ের সঙ্গে যুগের চাহিদা মিটাতে সংবাদপত্র ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চরিত্র হারানোর ফলে সংবাদপত্রেরও গতি-প্রকৃতি পুঁজিবাদীদের হাতে চলে যায়। উপেক্ষিত থাকে সাধারণ জনগণের বিষয়াদি। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সংবাদপত্রে খুঁজে পাওয়া যেন এক বিরল ঘটনা। অথচ এ সংবাদপত্রই এক সময় মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠেছিল। এমনকি এখনো সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমকেই আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অন্যতম স্তম্ভ ভাবা হয়।

সংবাদপত্র কিছু তথ্যের নিছক সমষ্টি নয়। সংবাদপত্র ইতিহাসের দলিল। অর্থাৎ সংবাদপত্র বাদ দিয়ে সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়। সংবাদের ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস, ধর্মীয় উত্থান-পতনের ইতিহাস, শিক্ষা-সভ্যতা বিস্তারের ইতিহাস, মন্বন্তরের ইতিহাস, দাঙ্গার ইতিহাস, স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসসহ সব ইতিহাসের সাক্ষী সংবাদপত্র। এমনকি কাগজের সংবাদপত্র থেকে আজকের ভার্চুয়াল সংবাদপত্রের ইতিহাসের সাক্ষী সংবাদপত্র।

ফরাসি বিপ্লবের সময় বিশ্ববাসী দেখেছে সংবাদপত্র কীভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ফ্রান্সের বুর্বোন রাজবংশের অপকর্মের বিরুদ্ধে নিয়মিত তথ্যভিত্তিক সংবাদপ্রকাশের মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল সংবাদপত্র। আর ১৯০ বছরের গোলামীর জিন্দেগীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও জনসচেতনতাকে একসময় এ সংবাদপত্রই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। সে সময়ের সব জাতীয় নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ গান্ধি, নেহেরু, আজাদ, প্যাটেল, লাল-বাল-পাল বলে খ্যাত ত্রয়ী রাজনীতিবিদ, অরবিন্দ, নেতাজী, চিত্তরঞ্জন, সলিমুল্লাহ, জিন্নাহ, ইকবাল, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীসহ সবার মূল আকর্ষণের জায়গা ছিল সংবাদপত্র।

শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের মানুষজনও সংবাদপত্রকে ব্যবহার করেছেন। রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, মধুসূধন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ ছিলেন এ তালিকায়। আর কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি সংবাদপত্রকে ব্যবহারই করেছেন গণসচেতনতার মাধ্যম হিসেবে। ফলে তিনি যে পত্রিকাই সম্পাদনা করতেন সেটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতো।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী প্রচারণাও এ পত্রিকার মাধ্যমে হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় রবীন্দ্রকুমার ঘোষাল লিখলেন, ‘ব্রিটিশরা সুকৌশলে ভারতীয় জনগণের মধ্যে অনৈক্য তৈরি করার জন্য বঙ্গভঙ্গ করেছেন। এই ৩০ কোটি জনগণ ভষিত্যের সাম্যের ভারত গড়তে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে ভারতীয়দের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে।’

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবি ও রাজনৈতিক চিন্তক ছিলেন না। তিনি একজন সফল সম্পাদকও ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার বেশকয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু উল্লেখযোগ্য পত্রিকা যেগুলো তিনি সম্পাদনা করেন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাসে নবযুগ এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। ব্রিটশবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, ক্রমান্বয়ে পত্রিকাটি বাঙালি জাতীয়কাবাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। নবযুগের মাধ্যমেই কবির সঙ্গে সাংবাদিকতা জীবনের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। বলা চলে কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় নবযুগ দিয়েই। আবার তার সাংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে নবযুগেই।

সাংবাদিকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই নবযুগে কাজী নজরুল ইসলাম লিখতে থাকলেন স্বাধীনভাবে। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করলেন। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতিবাদ চলতে থাকল নিরবচ্ছিন্নভাবে। এ যেন রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে স্বদেশপ্রেমে জাগ্রত করে তোলার মহৎপ্রাণ চেষ্টা।

বাংলার রাজনীতিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়কাল খুবই ঘটনাবহুল। ১৯৪১ সালের এ কে ফজলুল হক ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগদান করায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলেই তিনি সমালোচনার শিকার হন। এর প্রেক্ষাপটে এ কে ফজলুল হক নবযুগের প্রকাশনা দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতির জন্য তার চিন্তাচেতনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। প্রথাগত সাংবাদিকতার গণ্ডি ডিঙিয়ে নবযুগ নতুন মাত্রা যোগ করেন। রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। কাজী নজরুল ইসলামের নিজস্ব ঢঙে লেখা সম্পাদকীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। এ সময় আরেকটি দৈনিকের সঙ্গে নবযুগকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। সেই পত্রিকাটি হলো দৈনিক আজাদ। মতপার্থক্যের কারণে দৈনিক নবযুগ ও দৈনিক আজাদের লড়াই ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের বিশেষ ঢঙের সম্পাদকীয় দৈনিক নবযুগের পাঠকপ্রিয়তা ও গ্রহণীয়তা ছিল আকাশচুম্বী। তার সম্পাদকীয় বিশেষভাবে সবাইকে প্রভাবিত করত। এ পত্রিকার প্রধান কাজ ছিল বাঙালি মুসলিমদের জাগিয়ে তোলা। উল্লেখ্য, মুসলিম সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তুলতে ১৯৪১ সালের ২৯ নভেম্বর হাজী মুহম্মদ মহসিন সংখ্যা প্রকাশ করেন। এভাবে পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে দেশ গঠনের নানাদিক তিনি খেয়াল রাখতেন।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। এই নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিল সংবাদপত্রে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ সদ্য স্বাধীন ভারতের নতুন মানচিত্র এঁকেছিল। প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। এর পাশাপাশি যেসব রাজ্য তখনও পাকিস্তান বা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিল। বিশেষ করে আসাম, হায়দারাবাদ ও কাশ্মীরকে মানচিত্রে ফাঁকা রেখেই প্রকাশ করেছিল।

অন্যদিকে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ভারবর্ষের স্বাধীনতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এ পত্রিকায় কোনো ধরনের ছবি ছাপায়নি বরং নেহেরুর বক্তৃতার কিছু অংশ দিয়ে স্বাধীনতার পরবর্তী কি হতে পারে তা তুলে ধরে। এ সংবাদটি মূলত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করেছে। আইরিশ টাইমসও একই বিষয়ে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের এ সংব্দা প্রকাশের মূল কারণ তারাও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি চায়। ফলে তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরেন এবং স্বাধীন ভারতীয় জনগণের আনন্দের মুহূর্তগুলো তুলে ধরেন নিখুঁতভাবে।

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফও এ সংবাদটি প্রায় কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে প্রকাশ করেছিল। তবে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উপনিবেশিত। কেন না, তারা সেসব সংবাদকে গুরুত্ব দিয়েছিল, যেগুলো কেবল তাদের প্রশংসা করে। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে ভারতবর্ষের দুর্ভোগের কথা এড়িয়ে গিযেছিল। এভাবে বিশ্ব পত্রিকাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়, আমাদের কাছে এবং আমরা আগামীর পথ গড়তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পেরেছি।

সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান নামক দেশে বাঙালি সমাজ জাতীয়তাবাদ ও পরিচয় সংকটে ভুগে। এ সংকট আরো ঘনীভূত হয়, যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়ায়। এ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাঙালি মেনে নিতে পারেনি। তখন সংবাদপত্রগুলো এর প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি ছিল। জনমত তৈরিতে ছিল নিবেদিতপ্রাণ। এ পত্রিকাগুলো বাংলার পক্ষে এবং উর্দুর বিপক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-বক্তৃতাণ্ডগদ্য-পদ্য প্রকাশে সরব ছিল। ফলে ইস্যুটি খুব দ্রুত সব মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে এবং গ্রাম-গঞ্জ-শহর ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকে।

দেশভাগের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন, যে একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের কথা বলার অধিকার থকল না। এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছু পত্রিকা পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু দৈনিক উত্তেহাদ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বাংলার পক্ষে জোর দাবি জানান এবং জনগণের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান। দেশবাগের আগে দৈনিক আজাদ উর্দুর পক্ষে সমর্থন করে পাঠকপ্রিয়তা হারায়। অর্থাৎ একটি পত্রিকা যেমন দেশ গঠনে ভূমিকা পালন করে, তেমনি তাদের ভুল সিদ্ধান্তকে জনগণ ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না। আজাদের এ চরিত্র বরাবরই রহস্যে ঘেরা ছিল বলেই ৫২ সালের আগে তাদের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যেত না। কিন্তু ’৫২ পরবর্তী সময়ে পরিষ্কার করলেও জনগণ আর বিশ্বাস করেনি। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমুদ্দুন মজলিসের পক্ষে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকাটি প্রকাশ হলে এর নিবন্ধগুলো নিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি পত্রিকা এর পক্ষে সরব ছিল। অন্যদিকে শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ বাংলা ভাষার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।

১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষ্যে সংগ্রাম পরিষদেও পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৪ ফ্রেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় ধর্মঘটের ডাক দেয়।

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং এর পরবর্তী প্রেক্ষাপট ও ফলাফল সবার জানা। আর সব কিছুর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সংবাদপত্রের।

১৯৫২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ্য গণআদালতে প্রাদেশিক সরকারের বিচার দাবি করে সম্পাদকীয়তে বলে ছিল, ‘মুসলিম লীগ সরকার তার অতীতের সব কুকীর্তিকে স্নান করিয়াছে। আহত ছাত্র ও শিশুর ক্রন্দনে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত।

ছেলে হারা মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদে জনতাকে আকুল করিয়াছে। আজ পাকভূমির পাক রাজধানী এক শ্মশানে পতিত তাই সরকারের এই বর্বরতার ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতার সর্বত্রই আজ বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ জাগিয়া উঠিয়াছে। কেন তারা নিরীহ ছাত্র ও পথচারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালাইয়া কতগুলো মূল্যবান জীবননাশ করিল- তাই দেশের অযুত কণ্ঠের সঙ্গে মিলাইয়া আমাদের ঘোষণা শুধু ছাত্র জনতার ঘাতক সরকারি কর্মচারীদের নয়, এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের হোতা সরকারের বিচার চাই প্রকাশ্য গণআদালতে।

শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, পরবর্তী সময়ে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনেই ইত্তেফাক জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে পরিণত হয়, কেবল মাত্র জন-আকাঙ্ক্ষার কারণে।

অন্যদিকে সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশনার শুরু থেকেই বাংলা ভাষার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পত্রিকাটি প্রকাশ হয় ১৪ নভেম্বর ১৯৪৮। এ পত্রিকার সাংবাদিকরা ভাষাবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও কয়েকজন শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিক এর শহীর সংখ্যা। লাল কালিতে লাল বর্ডারে প্রকাশিত এই সংখ্যার উল্লেখযোগ্য শিরোনাম ছিল, শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্ত, রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলি বর্ষণ।’ এমন শত শত সংবাদ বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে সৈনিক পত্রিকা।

সাময়িকীর মধ্যে ঢাকা থেকে মাসিক অগত্যা ভাষার তাত্ত্বিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নান্দনিকভাবে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৪৯ সালে ১০৭ ইসলামপুর থেকে ফজলে লোহানীর সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। ছাপা হতো পুরোনো ঢাকার রমাকান্ত নন্দী লেনের পাইওনিয়ার প্রেস থেকে। অগত্যা লক্ষ্য করার মত বৈশিষ্ট্য ছিল, কায়েদে আজম বা মহাকবি ইকবালের কোনো স্তুতি না করে রবীন্দ্রনাথের উক্তি পুরাভাগে উদ্ধৃত করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তাবিষয়ক প্রবন্ধ ছেপে যাত্রা শুরু করেছিল। সোভিয়েত সাহিত্যিক আন্তভ চেকভ সম্পর্কে আলোচনা ও মার্কসীয় মতাদর্শ বিশ্বাসী সাহিত্যিক খাজা আহমদ আব্বাসের রচনার অনুবাদ এতে গুরুত্বসহ ছাপা হয়। প্রথম থেকে শেষ পার্যন্ত ইলিয়া ইলেমবূর্গ, এ্যালান মবর, আসাতোল ফ্রান্স, বালজাক, বার্নাডশ, হেমিংওয়ে, এগ্রিনিন, গোর্কিপ্রমুখ ও বিদেশি প্রগতিপন্থি লেখকের সাহিত্যে অনুবাদ অগত্যা বিশেষ মর্যাদায় ছাপা হতো। বিদেশি সেরা সাহিত্যির বিশেষজ্ঞ প্রগতিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়া দিয়ে সাহিত্যিক পরিমন্ডলে অগত্যা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের সময়কালে বিদ্রুপাত্মক এবং তীব্র সমালোচনামূলক ভাষায় মাসিক, অগত্যা, অবাঙালি ও উর্দু আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত তথা সামগ্রিকভাবে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের স্বপক্ষে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। নিদারুণ অর্থকষ্টে পত্রিকাটি ১৯৫২ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

৬ দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এ ৬ দফাকে জাতীয় রাজনীতির দাবিতে পরিণত করেছে সংবাদপত্র। সংবাদপত্র দেশের ও দশের কাছে এর গুরুত্ব এমনভাবে তুলে ধরেছে যা একসময় মানুষের প্রধান আন্দোলনে পরিণত হয়।

৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের কথা সবার জানা। এ সময়ের অন্যতম স্লোগান ছিল ‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক/শুয়োরমুখো ট্রাক এসেছে দুয়োর বেঁধে রাখ’। এ স্লোগানটি প্রকাশিত হতো নিয়মিতভাবে পত্রিকায়। আল মাহমুদও হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। এ জনপ্রিয়তার ফলে সফল আন্দোলনের মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে একধাপ এগিয়ে যায়। এরপর সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুষ বিজয়-এর পেছনে সংবাদপত্র একছত্র ভূমিকা পালন করেছে। আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংবাদপত্রের ভূমিকা কত নিবিড় ছিল তা অবিশাস্য ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামগ্রিকভাবে এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো পত্র-পত্রিকা এবং ছোট ছোট হ্যান্ডবিল বুলেটিন ইত্যাদি প্রকাশিত হত। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপ, রণাঙ্গনের খবরাখবর, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়ের সংবাদ, শরণার্থী শিবিরের দুর্দশা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা ধরনের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বোদ্ধা ও সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করার জন্যই মূলত এসব পত্রিকা প্রকাশিত হত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সময়ে শুধু অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, মুক্তাঞ্চল ও মুজিবনগর থেকে প্রায় ৬৪টি পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মুদ্রিত হলেও অধিকাংশ ছিল সাইক্লোস্টাইলের। ২-৩টি পত্রিকা বাদে বেশিরভাগই ছিল সাপ্তাহিক। তবে যেভাবেই প্রকাশিত হোক না কেন, সবগুলোর আদর্শ ও উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করার।

একইভাবে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রই একমাত্র ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ভাসানী সম্পাদিত ‘হক কথা’ তৎকালীন অনিয়মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিল। আমরা জানি গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা বিকাশে মওলানা ভাসানীর বিচক্ষণতা ও সাহস সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। তার রাজনৈতিক দর্শন ও আজন্ম সংগ্রামী ইতিহাস আজো দেশের মানুষের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। বাংলাদেশের জনগণ আজ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী চক্রান্তকারী আর শোষক-শাসকের দ্বারা শোষিত এবং নির্যাতিত। দেশ আজ দুঃসময় পার করছে। দেশের এই দুঃসময়ে এবং চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমরা মওলানা ভাসানীর মতো একজন দেশপ্রেমিক নেতার প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভব করি।

নব্বইয়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও এদেশের সংবাদপত্র স্বাধীন ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকেই এদেশের অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো সংবাদপত্রের উপর আঘাত শুরু করে এবং সংবাদপত্রগুলো পুঁজিবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যার ফলে পদলেহনকারীরা অন্যায়কারী ও জুলুমবাজদের পক্ষ নিয়ে যেমন কথা বলে এবং সন্ত্রাসী মনোভাপন্ন ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে সংবাদ উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করে থাকে।

ফলে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েক দশকে সংবাদপত্রগুলো শুধু সংবাদ পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা সমাজ বিনির্মাণেও ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-অর্থনীতি-রাজনীতি- খেলাধূলা-সাহিত্য-প্রযুক্তিসহ এমন কোনো বিষয় নেই যা উপস্থাপন করে না এবং এর মাধ্যমে সব ধরনের মানুষের মনোযোগ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম কেন না, সকল পর্যায়ে শুধু সস্তা খবর পরিবেশ এবং নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে জনদৃষ্টি ভিন্ন পথে নিয়ে ব্যবসা করাই এদের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আধুনিকতার দোহাই বা ফেরি করা হয়। যা এক রকম দেশদ্রোহীতার সামিল। কিন্তু এ সব বিষয়ে যেন এক গোষ্ঠী দিনের পর দিন বেপরোয়া।

বর্তমান সংবাদপত্রগুলোর দৈন্যদশা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন এরা রাজনৈতিক বা গোষ্ঠিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সংবাদ উপস্থাপন করে থাকে। এমনকি সাহিত্য পাতাতেও এর চাপ আরো প্রকট। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এরা অন্ধ অনুকরণ করে। তবে এতকিছুর মধ্যেও কিছু পত্রিকা রয়েছে, যারা সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সে সব পত্রিকার ভূমিকার কারণেই আগামী দিন স্বাধীনতার মূল স্বাদ এদেশের জনগণ একদিন উপভোগ করতে পারবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত