খাদ্য অপচয় রোধে চাই মিতব্যয় ও সচেতনতা

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

খাবারের অপচয় করতে নেই- খুবই সহজ সরল, সাদামাটা এই কথা সবাই জানে। তবে বাস্তবতা হলো, নামিদামি বুফে রেস্তোরাঁর টেবিল থেকে শুরু করে সাধারণ পরিবারের ডাইনিং টেবিল- সব জায়গাতেই খাবার-দাবারের ব্যাপক অপচয় হয়। শুধু এই দিকটা খেয়াল না রাখার জন্য কতটা বাড়তি খরচ যে আপনার হচ্ছে, সে হিসাব হয়তো আপনি নিজেও রাখছেন না। খাবারের অপচয় কিন্তু শুধু অর্থের অপব্যয়ই নয়; বরং নষ্ট করা খাবার প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপরও ফেলে নেতিবাচক প্রভাব। বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের ৮ শতাংশের জন্য দায়ী শুধু খাবারের অপচয়। খাবারের অপচয় এড়াতে এবং খাবারের ব্যয় কমাতে মিতব্যয় ও সচেতনতার বিকল্প নেই।

সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচির (ইউএনইপি) ওয়েবসাইটে বিশ্বের ‘খাবার অপচয়সূচক প্রতিবেদন ২০২৪’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে খাবারের এ অপচয়কে ‘বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বে খাবারের অপচয় নিয়ে এটি জাতিসংঘের সংকলিত দ্বিতীয় প্রতিবেদন। এটি তৈরিতে জাতিসংঘকে সহযোগিতা করেছে অলাভজনক সংস্থা ডব্লিউআরএপি। প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত খাবার অপচয়ের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে। ডব্লিউআরএপি বলছে, ‘এটা আমাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। আসলে বছরের প্রতিদিন এক বেলায় যত খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে বর্তমানে অনাহারে থাকা প্রায় ৮০ কোটি মানুষের সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব।’

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে একজন ব্যক্তি গড়ে বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেন, যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। বিশ্বে ২০২২ সালে অপচয় হওয়া খাবারের পরিমাণ ১০০ কোটি টনের বেশি, যা বিশ্ববাজারে আসা খাবারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বাসাবাড়িতে একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করে মালদ্বীপে-২০৭ কেজি। বিপরীতে সবচেয়ে কম খাবার নষ্ট হয় মঙ্গোলিয়ায়-১৮ কেজি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাসায় একজন ব্যক্তি বছরে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করে পাকিস্তানে-১৩০ কেজি। এরপরেই আছে নেপাল-৯৩ কেজি। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে মিয়ানমার (৭৮ কেজি), শ্রীলঙ্কা (৭৬ কেজি) ও ভারত (৫৫ কেজি)। সবচেয়ে কম ১৯ কেজি খাবার অপচয় হয়েছে ভুটানে। খাবার অপচয় সূচকের হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে একজন ব্যক্তি বাসাবাড়িতে গড়ে বছরে খাবার অপচয় করেছেন ৭৩ কেজি। যুক্তরাজ্যের তা ৭৬ কেজি। চীনের ক্ষেত্রেও হিসাবটা একই। তবে তুলনামূলক কম অপচয় হয়েছে রাশিয়ায়-৩৩ কেজি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে অপচয় হওয়া খাবারের ৬০ শতাংশই বাসাবাড়ির। এর পরিমাণ ৬৩ কোটি ১০ লাখ টন। ২৮ শতাংশ অপচয় হয়েছে রেস্তোরাঁ, ক্যানটিন ও হোটেলের মতো খাদ্য পরিষেবা ব্যবস্থাগুলোয়। কসাই ও মুদি দোকানে অপচয় হয়েছে ১২ শতাংশ খাবার। ওই বছরে অপচয় হওয়া ১০০ কোটি টনের বেশি খাবার ছিল বিশ্ববাজারে আসা খাদ্যদ্রব্যের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ যখন না খেয়ে আছে, তখন লাখো কোটি ডলারের খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে।

অন্যদিকে, জাতিসংঘের খাদ্যবর্জ্য কর্মসূচির (ফুড ওয়েস্ট প্রোগ্রাম) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে খাদ্য অপচয়ের ৫০ শতাংশ হয় সৌদি আরবে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং দেশটিতে খাদ্যবর্জ্যরে জন্য প্রতি বছর ৪০ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল ক্ষতি হয়। এদিকে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়। ২০২৩ সালে সৌদি শস্য সংস্থার (সাগো) একটি গবেষণা উঠে এসেছে, খাদ্য অপচয়ের কারণে সৌদি যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভোক্তা ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল। এ ছাড়া সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ৪ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন টন খাদ্য নষ্ট হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ পণ্যের সমতুল্য। গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে প্রায় ১৮৪ কেজি খাদ্য অপচয় করেন।

বিভিন্ন পরিসংখানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার উৎপাদন হয়, তার একটি বড় অংশ মাঠ থেকে আর খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ফুড ওয়েস্টেজ ফুটপ্রিন্ট : ইমপ্যাক্টস অন ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়, যা বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। খাদ্যের এ অপচয়ে উন্নত দেশ আর উন্নয়নশীল দেশ কেউই বাদ যায় না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেপ’ ২০২১ সালে ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স’ নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আর পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে। শুধু খাবার টেবিলের অপচয় রোধ হলেই ৪২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটত। আজ দুনিয়াব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে, অথচ অপচয় কমছে না।

খাদ্য অপচয়কে ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। বিশ্বনবী রাসুলুল্লাহ (সা.) খাবার অপচয় রোধে খুব শক্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। খাবার নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়ার কথা বলেছেন, যা সুন্নত। তিনি নিজেও দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার গ্রহণ করতেন, যাতে খাবার পাত্র থেকে পড়ে নষ্ট না হয়। কারণ খাবার হলো মহান আল্লাহর নিয়ামত। এর অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) খাওয়ার পর তার তিনটি আঙুল চেটে নিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কারো খাবারের লোকমা নিচে পড়ে গেলে সে যেন তার ময়লা দূর করে তা খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, আমাদের তিনি থালাও চেটে খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, খাদ্যের কোন অংশে বরকত রয়েছে, তা তোমাদের জানা নেই (তিরমিজি ১৮০৩)। খাবার নষ্ট করা যেমন অন্যায়, তেমনি গুনাহর কাজ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কোরআনে ইরশাদ করেছেন, (তোমরা) খাও, পান করো ও অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ ৩১) মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। (সুরা ইসরাইল ২৭) খাওয়া-দাওয়া ও পানাহারের ক্ষেত্রে অপচয় ও বিলাসিতা খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখোমুখি করে দেয়। তাই কোরআনে এটিকে কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছে- জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর খাদ্যদ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা হয়। এর ফলে যে শুধু পরিবেশ দূষিত হয় তা-ই নয়, পকেটটাও অনেকটা ছোট হয়। তবে অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রয়োজন অনেক শক্তি ও শৃঙ্খলা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে একটি পরিবার বছরে গড়ে ৭০০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৮৩০ ইউরো পর্যন্ত নিক্ষেপ করে থাকে আবর্জনার কনটেইনারে অর্থাৎ ফেলে দেওয়া খাবারের অর্থমূল্য এই রকম হবে। শুধু ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় চেইন স্টোর টেস্কোর মাল সরবরাহকারী ও ভোক্তারা প্রতি বছর ৬০,০০০ টন খাদ্যের অপচয় করে। এই অবস্থার পরিবর্তন চায় এখন টেস্কো।