রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বিচার

অপেক্ষার পাল্লা কেন যেন শেষ হচ্ছে না

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারাবিশ্বে সাড়া জাগানো সাভারের রানা প্লাজা ধসের মতো এমনি একটি মর্মান্তিক ঘটনার বিচার দীর্ঘ ১১ বছরেও সম্পন্ন হলো না- এটা একটা অস্বস্তিকর খবর। কেন হলো না, সেটা আদালতের ব্যাপার। তবে এতগুলো মানুষের জীবন গেল অথচ তাদের পরিবার বিচারটা পর্যন্ত এতো দিনে পেল না- এটা কাম্য নয়। আমাদের দেশের শ্রমিকরা কারখানার প্রাণ। তাদের হাত দিয়ে তৈরি হয় পণ্য। আর সেই পণ্য বিক্রি করে কারখানার মালিক যেমন লাভবান হয়, তেমনি শ্রমিকরাও তাদের মজুরি পান। সার্বিক অর্থে দেশ এগিয়ে যায়। বিচারের জন্য অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না। সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্রাঙ্গনের অনেকে জানতে পেরেছে। এতো বেশি সংখ্যক মানুষ একটি মাত্র দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার মতো ঘটনা, অন্য কোনো দেশে ঘটেছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশে কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে। বিদেশে বাংলাদের ভাবমূর্তি অনেকখানি খর্ব হয়েছে রানা প্লাজা ধ্বংস হওয়ার পর। আরো খর্ব হবে, যদি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা না যায়।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়েছিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল- এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমজীবী। আহত হয় আরো প্রায় ২ হাজার মানুষ। ভবন ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা করা হয়। এরই মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজউক এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুটি মামলা করে দুদক। দীর্ঘ ১১ বছরে চারটি মামলার মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা নিষ্পত্তি হলেও বাকি তিনটি মামলা নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না। এরই মধ্যে হত্যা মামলা ও ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় সাক্ষ্য শুরু হলেও অন্য মামলায় রয়েছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। আসামিপক্ষ বলছে, মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারহীনভাবে কারাগারে আটক রয়েছেন ভবন মালিক সোহেল রানা। অন্যদিকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির প্রত্যাশা রাষ্ট্রপক্ষের। সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভয়াবহ, বীভৎস ও হৃদয়বিদারক সেই ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন- মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউ বোন, কেউ স্ত্রী, কেউ স্বামী, আবার কেউ হারিয়েছেন তার প্রিয় মানুষটিকে।

সেদিন সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ধসে পড়ে সাভার বাজারের বাসস্ট্যান্ডের ৯তলা রানা প্লাজা। দেশের ইতিহাসে এটাই মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ওই ভবনের তৃতীয় তলা থেকে নবম তলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। এতে প্রায় চার হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ করতেন। ভবন ধসের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে চার হাজার পোশাকশ্রমিক। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে শোকের মাতম নেমে আসে পুরো সাভারে এবং সেটা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ভারী হয়ে ওঠে আকাশ। মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে যায়- সাধারণ উদ্ধারকর্মী, দমকল বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা। তাদের প্রচেষ্টায় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের হতে থাকে জীবন্ত ও মৃত মানুষ। উদ্ধার হওয়া আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে মহাসড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্স। তাদের হাসপাতালে পাঠানো, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানসহ সব ধরনের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ছুটে আসেন হাজারও স্বেচ্ছাসেবী। একে একে বের করা হয় জীবন্ত, মৃত ও অর্ধমৃত মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। হাসপাতালের মর্গ কানায় কানায় ভরে ওঠে। পরে লাশগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। স্কুল বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে লাশ রেখে দেওয়া হয়। লাশের সংখ্যা গুনতে স্কুল মাঠে ঝুলানো হয় বোর্ড। সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয় কফিনের বাক্স। ততক্ষণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া লোকদের স্বজনরা ছুটে আসেন রানা প্লাজার সামনে। তাদের কান্না আর আহাজারিতে গোটা আকাশটা ভারী হয়ে ওঠে।

প্রিয় মানুষটিকে জীবিত না পেলেও তার নিথর দেহটি নেওয়ার জন্য স্বজনরা ভিড় জমান অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। একটু পর পর লাশের গাড়ি এলেই তার দিকে দৌড়ে ছুটে যান স্বজনরা- এই বুঝি এলো তার প্রিয় মানুষটির লাশ। এভাবেই কেটে গেল ৫-৬ দিন। দিন যতই যেতে থাকে, ততই উদ্ধার হতে থাকে লাশ। এদিকে ধসের পর দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হতে থাকে। উদ্ধার তৎপরতায় ধীরগতি দেখে, কোনো কিছু না ভেবেই উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। উদ্ধার কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছিল না কারও। তবুও ভবনের নিচে আটকে পড়া মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ঢুকে পড়েছেন ধ্বংসস্তূপে। হাত-পা কেটে হলেও বের করে এনেছেন একেকটি জীবন্ত প্রাণ। পচা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করে তারা সন্ধান করেছেন জীবিত প্রাণের। ওই মানুষগুলোর কারণেই ধ্বংসস্তূপের ভেতরে থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া লাশ উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ১৩৮টি। ভবন ধসের ২০তম দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রানা প্লাজার উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেন। উদ্ধার কাজে গঠিত সমন্বয় কমিটির প্রধান নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী। তিনি উদ্ধার কাজ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ১২৭ জনকে মৃত ও ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানান। এরপরের দিন উদ্ধারকাজ শেষে ওই জায়গাটি ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকালও সেখানে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান হয়। দাবি জানানো হয় দোষীদের বিচারের আওতায় আনার।