ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাশরুম-স্বাদ ও পুষ্টির ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ

আফতাব চৌধুরী
মাশরুম-স্বাদ ও পুষ্টির ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ

মাশরুম বর্তমান বিশ্বে একটি সুপরিচিত নাম। আমাদের দেশের বাজার সৃষ্টি হয়েছে যার মাধ্যমে অনেক বেকার যুবক-যুবতী আর্থিক স্বনির্ভরশীল হতে পারে। এটি খুব সহজে এবং কম খরচে ঘরে চাষ করা যায়। মাশরুম মূলত এক প্রকার ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ। যার নানাবিধ গুণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য মাশরুমের চাষও দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। মাশরুম চাষ করে আমাদের দেশের বেকার সমস্যা এবং পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ সম্ভব। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো মাষরুম চাষের জন্য জমি বা মাটির কোনো প্রয়োজন নেই।

মাশরুমের খাদ্যগুণ : মাশরুম যেমন খেতে সুস্বাদু ও সহজ পাচ্য, তেমনি এতে শরীর গঠনের ও স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মাশরুমকে সুষম খাদ্য হিসেবে সুপারিশ করে। মাশরুম অপুষ্টি, উচ্চ রক্তচাপ, কোষ্ট বদ্ধতা, ক্যান্সার ও এইডস রোগ প্রতিরোধ করে। তাছাড়া মাশরুমকে বহুমূত্র রোগীর উত্তম খাদ্য হিসাবে অভিহিত করা হয়। কারণ মাশরুমে অতি কম মাত্রায় খাদ্যপ্রাণ প্রোটিনের সমতা আছে। গর্ভবতী ও হৃদরোগীর সুষম আহারও এ মাশরুম।

মাশরুমের জাত : পৃথিবীতে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির খাওয়ার মাশরুম আছে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ৭৫টি প্রজাতির উৎপাদন করা হয়। অবশ্য আমাদের দেশে মাত্র ৩টি জাতের উৎপাদন বেশি গ্রহণযোগ্য।

ক) ওয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম : এ জাতীয় মাশরুমকে ধিংরি ছাতুও বলা হয়। এ জাতীয় মাশরুম ধানের খড়ের উপর শীতকালে ২০ ডিগ্রি সে: তাপমাত্রায় করা হয়। কোনো কোনো এলাকায় অক্টোবর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চাষ করা সম্ভব।

খ) পেডিস্টত্থ বা পোয়াল মাশরুম : গ্রীষ্মকালে ধানের খড়ের উপর ৩০ ডিগ্রি থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেমি- তাপমাত্রায় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্তচাষ করা যায়।

গ) বাটন বা বোতাম মাশরুম : এটি সাধারণত ১৪ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি সে তাপমাত্রায় চাষ হয়ে থাকে। গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলে শুধু ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চাষ করা সম্ভব।

ঝিনুক মাশরুম চাষ : এ জাতীয় মাশরুমের উৎপাদন ক্ষমতা অন্য যে কোনো জাতের মাশরুমের চেয়ে বেশি। এদের দেখতে ধবধবে সাদা, সুন্দর ও মাংসুল। এর চাষাবাদের নিয়মগুলো হলো-

পন বা মাশরুম বীজ : মাশরুম বীজ অর্থাৎ পনের রং সর্বদা সাদা ধবধবে। বর্তমানে এ পন ২০০ গ্রামের পলিপ্যাকে পাওয়া যায়। বিশুদ্ধ পন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা উচিত। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে এ পন পাওয়া যায়। একটি বেড প্রস্তুত করতে প্রয়োজন হয় ১ কেজি শুকনো খড় এবং ১০০ গ্রাম বীজ। ৎ

মাশরুম ঘর : ঝিনুক মাশরুম চাষের জন্য দু-কোঠাযুক্ত ঠান্ডা বায়ু চলাচল করতে পারে এমন ঘরই উপযুক্ত। দুটো কোঠার একটিতে যাতে আলো প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য কালো কাপড়ের পর্দা ঝুলিয়ে দিতে হবে, যাকে অন্ধকার কোঠা বা পন রানিং রুম বলে। অন্য কোঠাতে শুধু আবছা আলো প্রবেশ করবে, যাকে চাষের কোঠা বলে।

ধানের খড় : বৃষ্টি পায়নি এমন শাইল ধানের পরিষ্কার খড়ই এ চাষের জন্য উত্তম।

কড়াই : খড় ভেজানো এবং শিদ্ধ করার জন্য এক বড় কড়াইর প্রয়োজন। প্রথম অবস্থায় যদি কড়াই কিনতে না পারেন তবে তেলের টিনের দ্বারা কাজ চালাতে পারেন।

পলিথিন ব্যাগ : বেড (খড় দিয়ে তৈরি মাশরুমের স্তূপ) প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজন ৬০ সেমি. ী ৪০ সেমি মাপের পলিথিন ব্যাগের।

মাঁচা বা রেক : বেডগুলো রাখার জন্য অন্ধকার ঘরে মাঁচা বা রেক এবং চাষের ঘরে ঝোলানোর ব্যবস্থা করতে হয়।

পাঞ্চ মেশিন ঃ পাঞ্চ মেশিন (ফুটো করার যন্ত্র) পলিথিন ব্যাগ ফুটো করার জন্য পাঞ্চ যন্ত্র দরকার। অবশ্য এ ফুটো করার জন্য অন্য কোনো বিহিত ব্যবস্থাও করতে পারেন।

প্রেয়ার যন্ত্র : বেডগুলোতে পানি ছিটানোর জন্য একটি প্রেয়ার যন্ত্রের প্রয়োজন। যদি সম্ভব না হয়, তবে বেডের উপরি ভাগে একটু গর্তের মত করে ধীরে ধীরে পানি দিলেই হবে।

চাষের পদ্ধতি : একটি বেড প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজন ১ কেজি ওজনের শুকনো শাইল ধানের খড় যাকে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি মাপের টুকরো করে কেটে নিতে হবে।

কাটা খড়কে পরিষ্কার পানিতে ১২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। একটি বড় কড়াইতে বা অন্য যে কোনো পাত্রে ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গরম করতে হবে। যেহেতু তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র নেই, সেহেতু পানিকে গরম করতে হবে যতক্ষণ না পানি থেকে বুদবুদ আকারে বিন্দু না উঠে। এখন পানিতে ডুবিয়ে রাখা খড়গুলোকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে সব খড় সমানভাবে সিদ্ধ হয়। কারণ খড়ের মধ্যে থাকা সব জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করাই হলো এ সিদ্ধ করার মূল উদ্দেশ্য।

এখন বীজ বা পন ব্যাগ থেকে বের করে ভালোভাবে ঝুর ঝুরে করে নিতে হবে, যাতে পনযুক্ত প্রতিটি দানা আলাদা হয়ে যায়। যেহেতু একটি ব্যাগে ২০০ গ্রাম বীজ থাকে এবং আমাদের একটি বেড তৈরি করতে ১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়, সে জন্য ইহাকে সমান দু’ভাগে ভাগ করে দুটো বেডের জন্য রাখুন।

এখন একটি ৬০ সেমি. মাপের পলিথিন ব্যাগ নিয়ে তাতে ৪০ থেকে ৬০টি ফুটো করে নিতে হবে, যাতে এ ফুটো দিয়ে বেডের মধ্যে বায়ু চলাচল করতে পারে। এখন এ ফুটো করা পলিথিন ব্যাগটিতে সে সিদ্ধ করা ঠান্ডা খড় এবং পন ঢোকানোর সময় প্রথমে সিদ্ধ করা ঠান্ডা খড়গুলোকে সমান ৫টি ভাগে ভাগ করতে হবে এবং সে ১০০ গ্রাম ঝোর-ঝোরে করা পনর বীজগুলো সমানভাবে ৪টি ভাগে ভাগ করে নিতে হবে।

এখন প্রথমে ফুটো করা পলিথিন ব্যাগে এক ভাগ সিদ্ধ খড় ঢুকিয়ে ঠেসে সমান করে তার উপরে চার ভাগ থেকে এক ভাগ পন বা বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবেই ফুটো করা পলিথিন ব্যাগের ভেতরে পাঁচটি খড়ের স্তরের মধ্যে চার ভাগ করা পনগুলোকে ছিটিয়ে দিয়ে ঠেসে ঠেসে সমান করে ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বেঁধে দিলেই বেড প্রস্তুত হয়ে যায়।

যদি খড় ও পন ভর্তির আগে ব্যাগটির তলদেশটাকে বেঁধে দেয়া হয়, তবে সুন্দর ও গোল বেড প্রস্তুত হবে। প্রস্তুত বেডকে অন্ধকার ঘরে মাঁচার বা রেকের উপর ১৪ দিন রেখে দিন।

১৪ দিন পর দেখা যাবে, সব পন গজিয়ে ব্যাশের মধ্যে খড়ের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং ছত্রাকের সাদা অনুসৃত চারদিকে দেখা যাবে। এইরূপ করাকে পন রানিং বলে। পেন রানিং হওয়ার পর বেডকে অন্ধকার কোটা থেকে সরিয়ে নিয়ে পলিথিন ব্যাগ থেকে বের করে উৎপাদনের জন্য উৎপাদন কক্ষে ঝুলিয়ে বা রেকে রাখতে হবে। সাবধানে বেড বের করলে পলিথিন ব্যাগকে পুনর্বার ব্যবহার করা যায়।

উন্মুক্ত করা বেডে দৈনিক সকাল-বিকাল ২ বার ছিটিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পলিথিন ব্যাগ থেকে বেড বের করার ৭-১০ দিনের পর মাশরুম সংগ্রহ করা যাবে। এভাবেই ৭-১০ দিন পর পর মোট ৩ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যাবে। এরপরও মাশরুম বের হতে পারে, তবে তা অনেক কম হবে। মাশরুম সংগ্রহ শেষ হয়ে গেলে বেডটিকে পচন সার হিসেবে ব্যবহার করা যায় অথবা গবাদি পশুদের খাওয়ানো যাবে। দেখা গেছে গাই-গরুকে খাওয়ালে দুধ উৎপাদন বাড়ে।

উৎপাদন : একটি এক কেজি শুকনো খড়ের বেড থেকে ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন হয়। তাজা মাশরুম ১ থেকে ২ দিন পর্যন্ত থাকে অন্যথায় ফ্রিজে বা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।

ফ্রিজে সংরক্ষণ : মাশরুম সংগ্রহ করার পর পরিষ্কার করে একটি কাগজের ব্যাগে ভরানো দরকার। এরপর এ ব্যাগটি অন্য এক পলিথিন ব্যাগে ভরানোর পর ফ্রিজের মধ্যে ৫ থেকে ৭ দিন রাখা যায়।

শুকিয়ে সংরক্ষণ : শুকিয়ে সংরক্ষণের জন্য রৌদ্রে কিংবা ড্রাইয়ার যন্ত্রে মাশরুম শুষ্ক করা হয়। টাটকা মাশরুম তুলে নেওয়ার পর পরিষ্কার করে নিয়ে একটি পাতলা কাপড়ে বেঁধে ৮৫ ডিগ্রি সে: উষ্ণতার ১৫ সেকেন্ড ডুবিয়ে নির্বিজন করে নিতে হয়। তারপর ঝরিয়ে নিয়ে ছোট ছোট টুকরায় কেটে নিয়ে শুকাতে হয়। শুকানোর জন্য পরিষ্কার চাটাইতে বা কাপড়ের উপরে মেলে দিয়ে কড়া রৌদ্রে ৩ থেকে ৪ দিন শুকাতে হয়।

ঠিকমতো শুকালে আঙুলের চাপে বিস্কুটের মতো ভেঙে যাবে। শুকানোর পর রৌদ্রে থেকে তুলেই টিনের কৌটায় বা কাচের বড়মুখ বোতলে অথবা পলিথিন ব্যাগে ভরে মুখ ভালো করে বন্ধ করে রাখতে হবে, যাতে বাতাস চলাচল করতে না পারে। শুকনো মাশরুম অনায়াসে ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে মাসে অন্তত একবার খুলে পরীক্ষা করে দরকার মত পুনঃরৌদ্রে শুকিয়ে অনেকদিন রাখা যায়।

মাশরুমের ব্যবহার : মাশরুম দিয়ে অনেক সুস্বাদু, সহজ পাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা যায়। যেমন করে অন্যান্য শাক-সবজি রান্না করা হয়, তেমন করে মাশরুমের নানান রকমের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা যায়। মাশরুম ফ্রাই, একক তরকারি বা অন্যান্য সবজির সঙ্গে মিশ্র সবজি তরকারি বানানো যায়। নিরামিষ সবজির মতো বা মাংসের মতো মিশ্র সবজি তরকারি তৈরি করা যায়। মাশরুম স্যালাড এবং মুখরোচক আচার বানানো যায়।

টাটকা বা শুকনো মাশরুমের স্যুপ বানিয়ে পরিবেশন করা যায়। শুষ্ক মাশরুমের চূর্ণের এক আকর্ষণীয় সুগন্ধ আছে। এ গুণকে কাজে লাগিয়ে মাশরুম দিয়ে কেক, পেস্টিত্থ এবং বিস্কুট তৈরি করা যেতে পারে।

এ মাশরুম চূর্ণ ব্যবহার করে কৃত্রিম গন্ধ দ্রব্যের ব্যবহার কমানো যায়। মাশরুম জাত দ্রব্য অধিক প্রোটিন যুক্ত হওয়ার জন্য অধিক পুষ্টিকর। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ নিরামিষ ভোজী। এদের সামনে মাশরুম উপস্থিত হবে, অন্যান্য স্বাদ ও পুষ্টির ভাণ্ডার নিয়ে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত