শিশুর সামগ্রিক বিকাশে স্কুলে প্রারম্ভিক শৈশব শিক্ষা

প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

স্কুলে শিশুদের প্রথম বছরগুলি, তাদের শেখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা সামনের দিকে পথ চলতে তাদের সারা জীবনের জন্য মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সফল সমস্যা-সমাধানকারী, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, শিল্পী এবং পরিবর্তন-নির্মাতাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা আমাদের শৈশবের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টিগতভাবে পরিলক্ষিত হয়। তারা জন্মলগ্ন থেকে কৌতূহলী, কল্পনাপ্রবণ এবং নিজেদের জন্য কিছু করার ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকে। শৈশবের এ শিক্ষা আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের বিশ্বের বিস্ময় আবিষ্কার করতে উৎসাহিত করে এবং তাদের ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী এবং যত্নশীল মানুষ হিসেবে অবদান রাখতে সক্ষম করে। শৈশবের শুরুর এ শিক্ষাকে আমরা সাধারণত প্রারম্ভিক বয়সি শিক্ষা (Early Years Education) বা প্রারম্ভিক শৈশব শিক্ষা (Early Childhood Education) বলে থাকি। আইবি কারিকুলামে এটি একটি বিশেষ পরিভাষা হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও আধুনিক বিশ্বের উন্নত কারিকুলামে এটি এখন বেশ সমাদৃত। ক্যামব্রিজ কারিকুলামে এটিকে ক্যামব্রিজ আর্লি ইয়ারস প্রোগ্রাম (Cambridge Early Years Programme), যাকে Cambridge EYP বলা হয়। এটি কেমব্রিজ পাথওয়ের প্রথম পর্যায়, যা ৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত সাফল্যের জন্য একটি পরিষ্কার পথ দেখায়। পিয়ারসন এডেক্সেল কারিকুলামে এটিকে Edexcel iPrimary Reception/Early Yea, যাকে সংক্ষেপে Edexcel রচজ বা Edexcel iPEY কারিকুলাম বলা হয়। এটি ৩ থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের জন্য একটি ২ বছরের প্রোগ্রাম। অন্যদিকে, আইবি (International Baccalaureate) কারিকুলামে অনেক আগে থেকেই এ প্রোগ্রামটি চালু রয়েছে। আইবি প্রাইমারি ইয়ারস প্রোগ্রাম (EYP) এর অংশ হিসাবে আর্লি ইয়ারস প্রোগ্রামটি (ঊণচ) বিবেচনা করা হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সি শিক্ষার্থীরা, তাদের উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার চেষ্টা করে এবং সহপাঠী, শিক্ষক, পরিবার ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে খেলার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

প্রায় দুই দশক আগেও আমাদের ছোটদের জন্য প্রাথমিক শৈশব শিক্ষার ধারণাটি যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে সত্যিই কোনো গবেষণা করা হয়নি। অতিতে জন্ম থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক শৈশব শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল, প্রাথমিকভাবে বাড়িতে খেলাধুলা করে সময় কাটানো, দাদা-দাদি বা নানা-নানীদের দ্বারা বর্ণিত গল্প শোনা এবং স্থানীয় পার্কে নিয়মিত ঘুরাঘুরি বা খেলাধুলা করা ইত্যাদি। কিন্তু গত দুই দশক বা তারও বেশি কিছু সময় ধরে প্রাথমিক শৈশব শিক্ষা ও শেখার ধারণার ওপর অনেক গবেষণা করা হচ্ছে এবং তাতে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে, মস্তিষ্কের বিকাশ গর্ভাবস্থার প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয়। আমরা হয়তো অনেকেই জানি যে, একটি শিশুর মস্তিষ্কে প্রতি সেকেন্ডে ৭০০ থেকে ১ হাজারটি নিউরাল সংযোগ তৈরি হয় এবং শিশুটির আড়াই থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে তার কথা বলার, শেখার, যুক্তি প্রদর্শনের এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষমতা ভালভাবে বিকশিত হয়। সুতরাং, শূন্য থেকে ৫ বছর সময়কালে শিশুদের বিকাশে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা বিশ্বের সাথে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে উঠতে পারে।

আধুনিক সভ্যতায় কর্মজীবী বা কর্মব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তান লালন-পালনের সুবিধার্থে এবং স্কুলের ক্রমোন্নত শিক্ষা ধারার সাথে খাপ খাওয়াতে, শিক্ষার এ স্তরটি পাঠ্যক্রমের মূলধারায় যুক্ত করা হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে প্রাক-প্রাথমিক (Pre-primary) নামে একটি শিক্ষার স্তর রাখা হয়েছে, যা মূলত আর্লি ইয়ারস প্রোগ্রামের মতোই খেলার মাধ্যমে শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাজানো হয়েছে। আর্লি ইয়ারস শিক্ষাধারা বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত কার্যকর ও মেধাবৃত্তিতে বেশ সহায়ক। বাবা-মায়ের পারিবারিক ও পেশাগত ব্যস্ততায় শিশুদেরকে সঠিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে এ শিক্ষাধারা এখন অনেক জনপ্রিয়। এজন্য ভালো ভালো স্কুলগুলোতে ডে-কেয়ারের নামে আড়াই থেকে ৫/৬ বছর বয়সি শিশুদের জন্য বিশেষ ঘরোয়া শিক্ষার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ডে-কেয়ারের শিক্ষা শেষে উক্ত শিশু শিক্ষার্থীদের ক্রমান্বয়ে প্রাত্যহিক স্কুলিংয়ের সমন্বয় করা হয়ে থাকে। এ আর্লি ইয়ারস শিক্ষা কার্যক্রম তরুণ শিক্ষার্থীদের জীবনের সর্বোত্তম শিক্ষার সূচনা তৈরি করে এবং তাদের প্রাথমিক মাইলফলকগুলো পূরণ করার মাধ্যমে স্কুলের ভেতর এবং বাইরে উন্নতি করতে সাহায্য করে। এটি শিশুদের শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, অনুধাবন এবং দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে। ফলে, তারা ক্যামব্রিজ প্রাইমারি বা আইবি মিডল ইয়ার্স প্রোগ্রাম (গণচ) কিংবা এডেক্সেল আই প্রাইমারিসহ অন্যান্য প্রোগ্রামে সহজেই যেতে পারে। আর্লি ইয়ার্স একটি শিশুকেন্দ্রিক, খেলাভিত্তিক প্রোগ্রাম যা শিশু শিক্ষার্থীদের তাদের নিজস্ব গতিতে বিকাশ করতে সহায়তা করে। এটি তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে, তাদের নিজস্ব পছন্দ নির্ণয় করতে এবং আত্ম মূল্যায়নের অনুভূতি আবিষ্কার করতে উৎসাহিত করে। মোটকথা, উচ্চণ্ডমানের শিক্ষার জন্য শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা এ আর্লি ইয়ার্স শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর্লি ইয়ার্স (Early Years) শিক্ষা কার্যক্রমে শিশুর বিকাশে মূলত: চারটি প্রধান লক্ষ্যকে বিবেচনা করা হয়; ১। সামাজিক বিকাশ (Social Development) ২। আবেগীয় ও মানসিক বিকাশ (Emotional and Mental Development) ৩। শারীরিক বিকাশ (Physical Development) ৪। বুদ্ধিভিত্তিক এবং একাডেমিক বিকাশ (Intellectual and Academic Development)

১। সামাজিক বিকাশ (Social Development): শিশু শিক্ষার্থীদের সামাজিক উন্নতিকে ‘সামাজিক সংযুক্তির দোলনা’ (The Cradle of Social Cohesion) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর্লি ইয়ার্স শিক্ষা সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত রেখে শিশুদের নিজেদেরকে বোঝার সক্ষমতা তৈরি করে। এটি শিশুদের মৌলিক দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি, ‘ধন্যবাদ’, ‘ক্ষমা করবেন’, “আমি ‘দুঃখিত’ ‘আসসালামু আলাইকুম’ এর মতো সম্মানজনক ও অভিবাদনমূলক ভাষা ব্যবহার করা শেখায়। এটি শিশুদের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে শেখায়। আর্লি ইয়ার্স শিক্ষা সামাজিক রীতিনীতিসহ, অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, সমতা, শান্তি, সহযোগিতার মনোভাব এবং মূল্যবোধগুলোকে শিশুদের মধ্যে এই বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে যে, তারা অন্যদের জীবনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

২। আবেগীয় ও মানসিক বিকাশ (Emotional and Mental Development): আর্লি ইয়ার্স শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা তাদের আত্মবিশ্বাস, আবেগের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, আত্ম-প্রকাশ, আত্মসম্মান এবং ইতিবাচক আত্মবিশ্বাসের মতো প্রয়োজনীয় মানসিক দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারে। সমস্যা সমাধান এবং স্বাস্থ্যকর ঝুঁকি গ্রহণের মতো পরবর্তী ক্রিয়াকলাপের জন্য এই দক্ষতাগুলো অপরিহার্য। ছোট ক্লাসের আকার এবং শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়ার (Interaction) সময় শিশুদের এই দক্ষতাগুলো এমন একটি পরিবেশে শিখতে সাহায্য করে, যেখানে তারা পারস্পরিক পরিচিতি ও যত্নশীলতাসহ প্রয়োজনীয় আবেগীয় দক্ষতাগুলি অনুশীলন করতে উৎসাহিত হয়। এ শিক্ষা শিশুদের মধ্যে একটি শক্তিশালী মানসিক ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে তারা বন্ধু, শিক্ষার্থী এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের মূল্য বোঝে। এ শিক্ষায় তারা তাদের ধারণা, আবেগ ও প্রয়োজনগুলো প্রকাশ করার ক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখে এবং তাদের ক্রমবর্ধমান জটিল সামাজিক-মানসিক ও একাডেমিক বিষয়ের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।

৩। শারীরিক বিকাশ (Physical Development) : আর্লি ইয়ার্স শিক্ষার স্তরটি একটি শিশুর স্থূল এবং সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতার বিকাশ, শারীরিক সমন্বয় (হাত-চোখের সমন্বয়, বাইক চালানো, দৌড়ানো ইত্যাদি), হাত ধোঁয়া, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর দক্ষতার বিকাশ ঘটায়। এ শিক্ষা কার্যক্রমে অনায়াসে পরিকল্পিত খেলা যেমন- সংবেদনশীল টেবিল সেটিং, নানা ধরনের পাজল গেম, পেইন্টিং, বিভিন্ন ডিভাইস সাজানো ইত্যাদির মতো আকর্ষক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক দক্ষতার বিকাশ লাভ করে। এ শিক্ষার স্তরে সূক্ষ্ম মোটর নিয়ন্ত্রণের উন্নতি করা থেকে শুরু করে তাদের ড্রেস পরা, জুতা পরা, ভেলক্রো স্ট্র্যাপ থেকে জরিযুক্ত জুতাতে স্থানান্তরিত করা, প্যাকিং করার মতো ক্রিয়াকলাপে আরো স্বাধীনতা অর্জন করা, তাদের স্কুল ব্যাগ, লাঞ্চ ব্যাগ এবং ব্যাকপ্যাক প্রস্তুত করার দক্ষতা শেখানো হয়।

৪। বুদ্ধিবৃত্তিক এবং একাডেমিক বিকাশ (Intellectual and Academic Development): যদিও প্রাথমিক শৈশব শিক্ষা প্রোগ্রামে সাক্ষরতা এবং সংখ্যা শেখার দক্ষতাগুলো যত্নসহকারে গবেষণা করা হয়, তবে একটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও একাডেমিক সাফল্যের ভিত্তি রচিত হয় এ আর্লি ইয়ার্স শিক্ষার স্তরে। এখানে একটি শিশু নিজেকে একজন দক্ষ শিক্ষার্থী হিসেবে দেখে এবং সে নতুন কোনো বিষয়ের সাথে এমনভাবে পরিচিত হয় যে, সে প্রথমে সেটিকে কঠিন বলে মনে করতে পারে, কিন্তু শিক্ষকের সাহায্যে সে যখন সেটিকে প্রাক্টিস করে, তখন সেটি তার কাছে অনেক সহজ হয়ে যায় এবং তখন সে এটির মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। এভাবে একটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ শ্রেণিকক্ষের বাইরেও প্রসারিত হয়; আর্লি ইয়ার্স শিক্ষা কার্যক্রম দ্বারা সমর্থিত শিক্ষার্থীরা শৈশব থেকেই সমগ্র বিশ্বকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে।

সুতরাং, আর্লি ইয়ার্স শিক্ষাক্রম শিশুদের জন্য যেহেতু একটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহলকে উন্নীত করে এবং তাদের পর্যবেক্ষণ, বিস্ময়, প্রশ্ন এবং আবিষ্কার করার ক্ষমতা বিকশিত করে, সেহেতু শিশুর পিতামাতা, তত্ত্বাবধায়ক বা অভিভাবকদের এ শিক্ষা-কার্যক্রমের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। একটি শিশুকে একটি শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ প্রদান করার জন্য, আর্লি ইয়ার্স শিক্ষা কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ শিক্ষা শিশুদের অসংখ্য একাডেমিক, সামাজিক-মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিধা প্রদান করে, যা আগামী কয়েক দশক ধরে শিশুর জীবনে প্রতিধ্বনিত হয়। অতএব, প্রত্যেক স্কুলে শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে এ জাতীয় আর্লি ইয়ার্স শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি থাকা আবশ্যক, হতে পারে সেটি ক্যামব্রিজ আর্লি ইয়ার্স বা এডেক্সেল আইপিআর/আর্লি ইয়ার্স কিংবা আইবি আর্লি ইয়ার্স প্রোগ্রাম। আমাদের সন্তান বেড়ে উঠুক খেলাধুলা ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে, যা তাদের মেধা ও মনন চর্চার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে বিকশিত করতে পারে।