ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দূষণের ভয়াবহতায় বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ : কারণ ও প্রশমন

মো. মিজানুর রহমান
দূষণের ভয়াবহতায় বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ : কারণ ও প্রশমন

দূষণ বিশ্বের মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ। বায়ু, পানি, মাটি, শব্দদূষণ, তেজষ্ক্রিয়তাজনিত দূষণসহ বিভিন্ন প্রকারের দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম। বায়ু হচ্ছে অনেক গ্যাসের সংমিশ্রণ এবং পরিমাণ ও বিভিন্ন রকম। বায়ুর উপাদানগুলো হলো নাইট্রোজেন ৭৮.০৮ শতাংশ, অক্সিজেন ২০.০৪ শতাংশ, আর্গন ০.৯৩ শতাংশ, কার্বন ডাই-অক্সইড ০.০৩৫ শতাংশ, নিয়ন ০.০০১৮ শতাংশ, মেথেইন ০.০০১৭ শতাংশ, হিলিয়াম ০.০০০৫ শতাংশ, ওজন ০.০০০০৬ শতাংশ, হাইড্রোজেন ০.০০০০০৫ শতাংশসহ বিন্দু ফোঁটা, বিন্দুকণা, ধূলিকণা, লবণকণা ও এ রকম আরো অনেক উপাদান। স্থান ভেদে বিন্দু ফোঁটা, বিন্দুকণা, ধূলিকণা, লবণ কণার প্রার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একজন সুস্থ পূর্ণ বয়স্ক মানুষ প্রতিদিন ১৬.৫ কিলোগ্রাম বাতাস গ্রহণ করে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে দূষণ হয় বেশি। বায়ুতে বিদ্যমান নির্দিষ্ট উপাদানের চেয়ে অতিরিক্ত বা অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু মিশে বায়ুর গুণাগুণ নষ্ট হওয়াকে বাযুদূষণ বলে।

ঢাকা শহরের বাযুদূষণের পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশ। গত ১৯ মার্চ, ২০২৪ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বৈশ্বিক বায়ুর মান প্রতিবেদন ২০২৩ প্রকাশ করে। এতে ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়, বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান ধরে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মানদ-ের চেয়ে ১৬ গুণ বেশি। ২০২৩ সালে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা শহর ছিল দ্বিতীয় শীর্ষ। [সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো (২০২৪), বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ, দৈনিক প্রথম আলো, ২০ মার্চ, ঢাকা]। বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) বায়ু মানসূচক তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্যাপস। ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড় মানছিল ২২১। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের বছরগুলোর ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় শতকরা ২ দশমিক ২৭ ভাগ বেশি। ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুর মান সূচক ছিল ২২৫ দশমিক ২ আর ২০২৪ সালে তা হয়েছে ২২৫ দশমিক ৪। আইকিউ এয়ারের মানদ- অনুযায়ী কোনো শহরের নম্বর ৫০ বাতার কম হলে বায়ুর মান ভালো ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে মাঝারি বা গ্রহণযোগ্য, ১০১-১৫০ হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর, ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে দুর্যোগপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। ২০২৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিন ছিল। যার ১৬ দিনই ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর, ১২ দিন অস্বাস্থ্যকর আর ১ দিন সতর্কতামূলক। [সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো (২০২৪), বায়ুদূষণের সঙ্গে বেড়েছে দূষণজনিত রোগও, দৈনিক প্রথম আলো, ৪ মার্চ, ঢাকা]। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এর মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ হার্ট অ্যাটাকে, ২৫ ভাগ ফুসফুস রোগে মারা যায়। বায়ুদূষণের উৎস হলো প্রাকৃতিক উৎস ও মানবসৃষ্ট উৎস। প্রাকৃতিক যেসব দূষিত পদার্থগুলো বায়ুতে মিশে মানুষের জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে বা হুমকির কারণ হয়, সেসব পদার্থ দূষিতকরণের উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। প্রাকৃতিক দূষিত পদার্থগুলো আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আগ্নেয় ভস্ম, সালফার ডাই-অক্সাইড, সালফার ট্রাই অক্সাইড, দাবানলের ফলে ধোঁয়া, কার্বন ডাই-অক্সাইড, উষ্ণপ্রসবন এলাকায় সালফার ডাই অক্সাইড, সালফার ট্রাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন সালফেট, ধূলি-ঝড় এলাকায় ধুলিকণা, সমদ্র তরঙ্গ এলাকায় সুক্ষè লবণ কণা, বনভূমি বা অরণ্য এলাকায় পরাগ রেণু ইত্যাদি। প্রাকৃতিক উৎসসমূহের মধ্যে আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত ও দাবানল বাংলাদেশ বর্তমানে নেই; আর মানবসৃষ্ট কারণগুলো নিম্নে উল্লেখিত। বিশ্বায়নের যুগে পরিবেশবান্ধব শিল্প ও কল-কারখানা গড়ে না উঠলে মোটরযান উৎপাদন কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গৃহ উত্তাপন যন্ত্র, খনিজ তৈল শোধনাগার, কাগজের কল, প্লাস্টিক কারখানা, সার কারখানা, ধাতব শিল্প-কারখানাসহ অন্যান্য কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, ভস্ম, বিষাক্ত বাস্প, ধাবত অক্সাইডগুলো, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, সালফার ট্রাই অক্সাইডগুলো বাযুকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে। নগরায়নের যুগে শুষ্ক মৌসুমে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ড্রেনেজ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও মেরামতের জন্য শহরে বিশেষ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলে ফলে বায়ুতে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। ড্রেন পরিষ্কারের জন্য বর্জ্যগুলো স্তূপ করে রাখার ফলে সেখানে প্যাথজেনের উপস্থিতির কারণে বায়ুদূষণ হয়। ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলার ফলে এসব গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, কল-কারখানার ধোঁয়া, ঢাকার চারপাশে বিশেষ করে ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণ করে। ঢাকার চারপাশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটভাটা আছে। কাজেই যেদিক থেকেই বায়ু প্রবাহিত হোক না কেন, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসের মাধ্যমে ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করবেই। ইটভাটায় কাঠ, কয়লা পোড়ানোর ফলে এসব থেকে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পার্টিকুলেট কার্বন, ওজন, সিসা, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড এবং ভাসমান বস্তু কণাগুলো দূষণ করে বায়ুমন্ডল। বাড়ি নির্মাণ ও মোটর গাড়ি শিল্পে অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করলে তা থেকে বায়ুদূষণ হয়। ধূমপানের ফলেও বায়ুদূষণ হয়। বালি, মাটি, ইট, সিমেন্ট, খোয়া ইত্যাদি ভবন নির্মাণ সামগ্রী একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন, পুরাতন ভবন ভেঙ্গে ফেলা ও নতুন ভবন স্থাপননের ফলে বায়ুদূষণ হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরি, ভারী ধাতু নিষ্কাষণের সময় সীসা বা ক্যাডমিয়াম জাতীয় ভারী ধাতু বায়ুতে মিশে বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলে। রং, সিলমোহর ও কাঠশিল্প থেকে ফরমাল ডিহাইড উপস্থিতির কারণে বায়ুর গুণগত মান নষ্ট হয় এবং চোখ, গলা, নাক জ্বালা পোড়া করে। ক্ষেত্র বিশেষে ক্যান্সারের জন্যও দায়ী। যেখানে সেখানে ময়লা-আর্বজনা ফেলার ফলে নির্গত রোগ-জীবাণু বায়ুতে মিশে দূষিত করে। ট্যানারি থেকে নির্গত বর্জ্য, জৈব-অজৈব পদার্থ ও বিষাক্ত গ্যাস বায়ুকে দূষিত করে এবং মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এই বিষাক্ত বায়ু শুধু মানবদেহেই নয়; ইলেকট্রনিক্স ও বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসে (যেমন- রেডিও, টিভি) পরে তার কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। ডিজেল, পেট্রল, ব্যাটারি, হেয়ারড্রাই, পাউডার রং ইত্যাদি পণ্য থেকে সিসা বায়ুতে মিশ্রিত হয়। ফলে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। বায়ুতে থাকা অতিরিক্ত সিসা শিশুদের মানসিক বিকাশকে বাধা দেয়, মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে, প্রজনন ও মুত্রগ্রন্থির কার্যক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। শুষ্ক মৌসুমে বায়ুতে বেশি সিসা থাকে। ঢাকার মধ্যেই প্রতি বছর প্রায় ৫০ টন সিসা নির্গত হয়। পরিবেশ দূষণ তথা বায়ুদূষণ রোধকরা সম্ভব নাহলে ভবিষ্যতে মারাত্মক প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিবে। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য বিভিন্ন দপ্তর বা সংস্থাসমূহের মধ্যে নিয়মিত মতবিনিময় করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য প্রচলিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিকল্প বা নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ভালো কাজ দিবে। প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা-আর্বজনা ফেলতে হবে।

পরিবেশবান্ধব রান্নার চুলা ব্যবহার করতে হবে। আগুনে পোড়া ইটের পরিবর্তে স্যান্ড ব্রিকের ইটের উৎপাদন বা বিকল্প ইট উৎপাদন করতে হবে এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। ইটভাটায় বা শিল্প কল-কারখানায় বায়ু শোধন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরিবশেবান্ধব উৎপাদনের জন্য অন্তর্জাতিকভাবে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন নির্মাণের সময় ঢেকে রাখতে হবে এবং নীতিমালা মেনে চলতে হবে। শহরের ভেতরে মাত্রাধিক বোঝাইকৃত ট্রাক ও বাস চলাচল নিষিদ্ধ করা দরকার। ঢাকা শহরের জন্য যুগোপযোগি পরিবেশবান্ধব ট্রাফিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। সর্বোপরি বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথভাবে মনিটরিং করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে প্রশাসনের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রচারণা করে বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে সর্বোপরি সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত