মে দিবস

ইতিহাস ও আজকের বাস্তবতা

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পহেলা মে। ঐতিহাসিক মে দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক শ্রেণির এক অনন্য দিন। ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছিল শ্রমিকরা। শাসক মালিকগোষ্ঠীর হিংস্র আক্রমণে সভ্যতার নির্মাতা শ্রমিকের তাজা রক্ত ঝরছিল সেদিন। অধিকার আদায়ের স্বার্থে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা। পহেলা মে থেকে চার দিনের বেদনাবহ ও গৌরবময় ঘটনাবলী স্মরণে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর শ্রমিকদের মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিনটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এই দিনটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। কেবল শ্রমিকরাই যে এদিনটি পালন করছে তা নয়, শাব্দিক অর্থে যারা শ্রমিক নন, তারাও এখন মে দিবস পালন করেন। কারণ দিনে-দিনে প্রমাণিত হয়েছে, সভ্যতার বিনির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকা বিরাট। ওদের শ্রম ছাড়া সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব নয়। কিন্তু গোড়াতে শ্রমিকদের ন্যায়সংগত দাবি তাদের নিজেদের লড়াই করেই আদায় করতে হয়েছে। অন্যরা মালিকদের শোষণ সমর্থন করে তাদের দাবির বিরোধিতাই করেছিলো। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তদান বৃথা যায়নি। উত্তরকালে শ্রমিকদের রোজ আট ঘন্টা খাটুনির দাবি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই স্বীকৃত হয়নি, এটি স্বীকৃত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে সারা বিশ্বে। এখন যে কোনো দেশে আট ঘণ্টার বেশি শ্রমদান ও শ্রম আদায় নিষিদ্ধ। এছাড়াও শ্রমিক শ্রেণির বহু দাবি অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। আজকের দিনে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবসের তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য ১৮৮৬ সালের মে দিবসের ইতিহাস এবং এর পুর্বাপর ঘটনাবলী বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা দরকার। ১৮০৬ সাল। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মামলা চলছে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে। এই মামলায় ফাঁস হয়ে গেল যে, কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের ঊনিশ থেকে বিশ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটিয়ে মারে। তখনকার প্রচলিত অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী দিনের কাজের ঘণ্টা হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এর প্রতিবাদে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকেই প্রতিবাদ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা। ১৮২০ সাল। আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে ছোট-ছোট স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো একত্র করে একটা ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয়। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে কাজের ঘণ্টা কমাবার দাবিতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলতে থাকে। অনেক শিল্পকেন্দ্রে দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু করার সুনির্দিষ্ট দাবি তোলা হয়। ১৮২৭ সালে বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম হয় ফিলাডেলফিয়ার গৃহনির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের উদ্যোগে। ওই শ্রমিকরা তখন দৈনিক দশ ঘণ্টার দাবিতে ধর্মঘটে ছিলেন। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কে রুটি শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এ ব্যাপারে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ এ লেখা হয়, ‘মিসরে যে ক্রীতদাস ব্যবস্থা চালু আছে তার চাইতেও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর শ্রমিকদের কাটাচ্ছেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে আঠারো থেকে বিশ ঘণ্টা ওদের খাটতে হয়।’ দৈনিক দশ ঘণ্টার দাবি খুব দ্রুত আন্দোলনের আকার ধারণ করে। ফলে ১৮৩৭ সালের মন্দার সময়েও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সরকারি কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য দশ ঘণ্টা রোজ বেঁধে দেয়। পরবর্তী বছরগুলোতে বেসরকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এই আইন কার্যকর করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চলতে থাকে। দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের সময়, শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষাব্যবস্থা, দেনা শোধ করতে না পারলে শ্রমিকদের জেলে পাঠানোর আইনের বিলুপ্তি, অপ্রাপ্ত বয়সি ও মহিলা শ্রমিকদের কাজের ও মজুরির সুযোগ-সুবিধা প্রদান প্রভৃতি দাবিতে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। কিন্তু সংগঠনের দুর্বলতা, নেতাদের মধ্যে মতভেদ এবং ১৮৩৭ সালের মন্দার কারণে ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৫০ সালের দিকে অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা উন্নতি দেখা দেয় এবং শ্রমিকরাও তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে। সর্বত্র শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ায় প্রবল উদ্যোগ দেখা দেয়। এই সময় থেকে শ্রমিকরা দশ ঘণ্টার জায়গায় আট ঘণ্টা রোজের দাবি তোলেন এবং আমেরিকাসহ সব উদীয়মান পুঁজিবাদী দেশে আট ঘণ্টা রোজের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৬১ সাল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ প্রায় সব সক্ষম পুরুষই যুদ্ধক্ষেত্রে। কল-কারখানায় শ্রমিকের অভাব। অর্থকষ্টের কবলে শ্রমজীবী পরিবারগুলো। যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে কলকারখানা চালু রাখা চাই। মেয়েরা, শিশুরা জীবীকার তাগিদে দলে-দলে কল-কারখানায় কাজ নিতে থাকল। এই সুযোগে মালিকরা তাদের শোষণ ও অত্যাচার বাড়িয়ে যেতে থাকল। যুদ্ধের অজুহাতে শ্রমিকদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার অজুহাতে এই নারী ও শিশু শ্রমিকদের অত্যন্ত কম মজুরি দিয়ে যথাসম্ভব বেশি খাটিয়ে নিয়ে মালিকরা লাভবান হতে থাকে। ফলে ১৮৬২ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন কল-কারখানায় শুরু হয় ধর্মঘট এবং উৎপাদনে অসহযোগ। এই বিছিন্ন ধর্মঘটগুলোর মাধ্যমেই আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

১৮৬৬ সাল। মে দিনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরের ২০ আগস্ট আমেরিকায় ৬০টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা বাল্টিমোরে মিলিত হলেন। প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। তখন থেকেই লন্ডনে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ এর সাধারণ পরিষদের সাথে ইউনিয়নের গভীর সখ্যতা ও নৈকট্য গড়ে ওঠে। এই সময়েই সর্বপ্রথম আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি ওঠে। ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে বাল্টিমোর সম্মেলনে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়; ‘এই দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে পুঁজিবাদীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য এই মুহূর্তের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো এমন একটি আইন পাস করা যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যের সাধারণ কাজের দিন হবে আট ঘণ্টা। এই মহান লক্ষ্য পূর্ণ করার পথে আমরা সমস্ত শক্তি নিয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করছি।’

বাল্টিমোর সম্মেলন পরবর্তী বছরগুলোতে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬৯ সালে ইউনিয়ন ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ এর বেল কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠায়। প্রতিনিধি হিসাবে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি উইলিয়াম এইচ সিলভিসের যোগদানের কথা ছিলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্মেলনের আগেই তার মৃত্যু ঘটে এবং প্রতিনিধি হিসাবে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ পত্রিকায় সম্পাদক এসি ক্যামেরন কংগ্রেসে যোগদান করেন। সিলভিসের মৃত্যু ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের চরম বিপর্যয় ডেকে আনে এবং অচিরেই এর বিলুপ্তি ঘটে। ১৮৭০-এর দিকে সারা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, বালিজ্যিক মন্দা। মন্দার অজুহাতে মালিকরা মজুরি কমানো, শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রম ঘণ্টা বাড়ানো প্রভৃতি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকল। শ্রমিকরাও এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন শুরু করেন। কাজের ঘণ্টা কমাবার আন্দোলন এই সময়কার বেকারত্ব ও দুঃসহ-দুরবস্থার কারণে আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ওদিকে মিল মালিক শিল্পপতিরা শ্রমিক সংগঠনগুলো ধ্বংস করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে প্রচণ্ডভাবে। লেন্সের জানিয়ায় কয়লাখনি মালিকরা ১৮৭৫ সালে খনি অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করার ইচ্ছায় দশজন সংগ্রামী খনি শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝোলায়। এর পরিণতিতে ১৮৭৭ সালের রেল ও ইস্পাত ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ১৮৮০ সাল থেকে ১৮৯০। এই দশ বছরে মার্কিন শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। তবে এরই মধ্যে ১৮৮৪-৮৫ সালে আবারও মন্দার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরইমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সংক্ষেপে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’-এর জন্ম হয়। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর এই সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনের একটি প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৮৮৬ সালের পহেলা মে থেকে দৈনিক আট ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এই সঙ্গে আমরা সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের কাছে সুপারিশ করছি যে, তারা যেন উপরোক্ত তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ এলাকায় আইন-কানুন পরিচালনা করেন। একই সাথে ফেডারেশন নাইটস অব লেবারের কাছে আবেদন করলেন যাতে করে তারা এ আট ঘণ্টার দাবির আন্দোলনের পেছনে সমর্থন জানান। নাইটস অব লেবার ফেডারেশনের তুলনায় পুরোনো এবং তখনো একটি বিস্তৃত প্রতিষ্ঠান। ১৮৮৫ সাল। ফেডারেশনের সম্মেলন থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো, পরবর্তী বছর পহেলা ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসা হবে। কয়েকটি জাতীয় ইউনিয়ন আসন্ন সংগ্রামের জন্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই ইউনিয়নগুলোর মধ্যে কার সেন্টার ও সিগার মেকারদের ইউনিয়ন দুটো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মে দিবসের আন্দোলন শুরু হবার সাথে সাথে ফল ফলতে শুরু করে। ইউনিয়নগুলোর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। নাইটস অব লেবার কথাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফেডারেশনের তুলনায় নাইটস অব লেবার অধিক পরিচিত ছিল। তখন এটাকে একটি সংগ্রামী সংগঠন বলে মনে করা হতো। এর সদস্য সংখ্যা দুই লাখ থেকে বেড়ে হয় সাত লাখ। আট ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিল ফেডারেশন। ধর্মঘটের তারিখও ঠিক করেছিল এই সংগঠন। ফলে এর সদস্য সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে। ধর্মঘটের দিনটি দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে আট ঘণ্টা শ্রম সমিতি। অসংগঠিত শ্রমিকরাও দ্রুত সংগঠনভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু‘ অচিরেই একটি গোপন ব্যাপার ধরা পড়ল-নাইটস অব লেবার গোপনে আসন্ন ধর্মঘটের বিরোধিতা করছে। তারা ধর্মঘট না করার জন্যও গোপন পরামর্শ দিচ্ছে। এই অবস্থায় বিশ্বাসঘাতক নেতাদের সমুচিত জবাব দেবার জন্য ফেডারেশন ধর্মঘটকে আরো জোরদার করার প্রস্তুতি নেয়।

রক্তে রাঙানো দিনগুলো- পহেলা মে ১৮৮৬। শনিবার। সমগ্র শিকাগো শহর নিস্তব্ধ। চালু নেই কোনো কল-কারখানা। মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মঘটী শ্রমিকরা। মিছিল যাবে মিশিগান এভিনিউ দিয়ে লেক ফ্রন্টের দিকে। ছয় লাখ শ্রমিক জড়ো হয়েছে। তালা ঝুলছে ১৫৭২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে। ১১ হাজার ৫৬২টি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। সরকার ও মিল মালিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করল মিছিল বন্ধ করার জন্য। কাগজগুলোর মাধ্যমে আগেই গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, শ্রমিকরা ধর্মঘট ও মিছিলের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লুটতরাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সশস্ত্র পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে শ্রমিক ও জনসাধারণের মিছিলে অংশগ্রহণ রোধ করার জন্য। কিন্তু সরকার, মালিকগণ এবং কাগজওয়ালাদের সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল এগিয়ে চলেছে মিশিগান এভিনিউর দিকে। শ্রমিক নেতা পারসনস ও স্পাইজের নেতৃত্বে। লেক ফ্রন্টে প্রায় এক লাখ শ্রমিকের সমাবেশে সাফল্যের জন্য শ্রমিকদের অভিনন্দন জানালেন। মিল মালিক ও কাগজওয়ালাদের গুজব সত্ত্বেও কোথাও কোনো অশান্তি ঘটল না। শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো শ্রমিকদের মিছিল ও সমাবেশ। পরের দিন রোববার। ছুটির দিন। কোনো ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে কেটে গেল দিনটি। কিন্তু ৩ মে সোমবার আবার কারখানায়-কারখানায় শুরু হলো ধর্মঘট। উস্কানি ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ দ্বারা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার ও মালিক পক্ষ। ম্যাক কর্মিক হারভেষ্টার নামক লক আউট কারখানার সামনে সমবেত শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ গুন্ডারা। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ছয়জন শ্রমিক। পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণে আহত হলো অগণিত শ্রমিক। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেটে প্রতিবাদ সভা ডাকা হলো ৪ মে। গত দিনের শ্রমিক হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটল। ঘাবড়ে গেল মালিক পক্ষ। যে কোনো মূল্যে প্রতিবাদ সভা বানচাল এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংহতি ও সংগ্রামী চেতনাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত করল প্রশাসন যন্ত্রকে, ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীকে। শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে প্রতিবাদ সভা। শেষ বক্তা ফিল্ডেন উঠেছেন বক্ততা করতে। তখন রাত প্রায় ১০টা। শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে জনসভা তখনই ভেঙে দেবার নির্দেশ নিয়ে উপস্থিত হলেন শিকাগো পুলিশের বড় কর্তা। প্রতিবাদ করলেন শ্রমিক নেতারা। পুলিশের সাথে শ্রমিক নেতাদের কথা কাটাকাটির সুযোগে গুন্ডারা সভার বিভিন্ন অংশে বোমা ফাটাতে শুরু করে। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি। ভিড়ের মধ্যে একটি বোমা এসে পড়ে এবং তার আঘাতে নিহত হন একজন সার্জেন্ট। সাথে সাথেই বেধে যায় লড়াই। রক্তের বন্যা বয়ে যায় হে মার্কেটে। এই দিনে নিহত হয় সাতজন পুলিশ, চারজন শ্রমিক। স্পাইচ এবং ফিল্ডেনকে সভাস্থলেই গ্রেফতার করা হয়, দাঙ্গা-হাঙ্গামার দায়ে। আরো গ্রেফতার হলেন মাইকেল মোয়া, জর্জ এঞ্জল, এডলফ ফিশার, লই কিং ও অস্কার নীবে।